তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন খেটে খাওয়া শ্রমিক, চা বিক্রেতা, তেমনি ছিলেন তরুণ শিক্ষার্থীরা। সবার একটিই দাবি- কাদের মোল্লার ফাঁসি, সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা।
মঙ্গলবার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদেণ্ডের রায় ঘোষণার পর ওইদিন সন্ধ্যায় আরো অনেকের সঙ্গে শাহবাগে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আদনান সাকিব। ছিলেন পরদিন সকাল ১১টা পর্যন্ত। এরপর হলে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে বুধবার দুপুরে আবার ফেরেন শাহবাগে। সেখানে বসেই বৃহস্পতিবার ভোর দেখেছেন তিনি।
“আজ সকালে সমাবেশ আর আগামীকাল মহাসমাবেশ আছে, সবাইকে এই সমাবেশে ডাকা হয়েছে। তবে আমরা এই কর্মসূচির আগে-পরের সময়টাতেও শাহবাগেই থাকতে চাই। মহাসমাবেশ থেকে ঘোষিত পরবর্তী কর্মসূচিতেও আমরা খাকব এখনকার মতোই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ ছাড়ব না”, বলেন সাকিব।
কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা মো. মাসুদ জানান, টেলিভিশনে এই সমাবেশের খবর দেখে আর থাকতে পারেননি। ছুটে এসেছেন একাত্ম হতে।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার রাজমিন্ত্রি (২১) মো. মাসুদ জানান, ঢাকায় থেকে কাজ করে যা আয় হয় তার একটা অংশ দেশের বাড়িতে পাঠান মায়ের জন্য। দুদিন কাজ বন্ধ রেখে শাহবাগের আন্দোলনে যোগ দেয়ায় সমস্যা হয়তো কিছু হবে, কিন্তু ‘বিবেকের ডাকে’ সাড়া না দিয়ে তিনি পারেননি।
“মানুষের জীবনতো সব সময় একভাবে যায় না। যুদ্ধের সময়তো আমার বয়সী অনেক মানুষই সব ছেড়ে অস্ত্র ধরেছেন। আমারতো সেই সুযোগ হয়নি। তাই সেই যুদ্ধে যারা আমার দেশের বিরোধিতা করেছিল তাদের বিচার চাইতে এসেছি।”
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
মঙ্গলবার রাতভর প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের দাবি জানিয়ে নতুন দিন শুরু করে আন্দোলনকারীরা।
বুধবার সকালের আলো ফোটার পর জামায়াতের হরতালের মধ্যেও বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ দলে দলে শাহবাগের জনস্রোতে ভেসে পড়ে। শিশু-তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে নতুন উদ্যমে আবার শাহবাগে বিক্ষোভ শুরু শুরু হয়।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সমাবেশের বিস্তার শাহবাগ চৌরাস্তায় থাকলেও সন্ধ্যার পর তা দক্ষিণে চারুকলা, উত্তরে রুপসী বাংলা হোটেল, পশ্চিমে আজিজ সুপার মার্কেট এবং পূর্বে শিশু পার্ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
সমবেত কণ্ঠে স্লোগান চলে গান, কবিতা, সড়কে চিত্রাঙ্কণ, বক্তব্য। এরই মাঝে বিভিন্ন দলের, বিভিন্ন সংগঠনের, বিভিন্ন পেশার জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা এসে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সংহতি জানান।
বুধবার রাত ২টার দিকে শাহবাগে বড় পর্দায় ‘হাঙর-নদী-গ্রেনেড’ চলচ্চিত্র দেখার সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেকানিক ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল থেকে শরীরডা ভালো ছিলো না। এরজন্য দিনে কাম করতে পারি নাই। সন্ধ্যায় আচমকা স্যার (অফিসের বস) ফোন কইরা গাড়ি (মোবাইল টয়লেট ও পানির গাড়ি) নিয়া শাহবাগে আসতে কইলেন। স্যারের কথায় অসুস্থ্য শরীর নিয়া চইলা আসছি। অহন মনে হইতাছে, না আসলে ভুল হইতো। রাজাকারগো বিচার চাইতে এত মানুষ আসছে আমি কেন আসমু না? আমিওতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।”
ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা আব্দুর রউফ রাত ৪টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্যান্য দিন এতরাতে চা-সিগারেট বিক্রি করি না। কিন্তু দিনে এখানে এসে আর যেতে পারিনি। চিন্তা করলাম থেকে যাই। স্লোগান দেব, দাবিতো আমারো।”
লীলফামারি থেকে ঢাকায় আসা রিকশাচালক মোখলেসুর রহমান দুইদিন ধরে সমাবেশের আশেপাশেই থাকছেন। পেটের দায়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে, কিন্তু দূরের কোনো খ্যাপ নিচ্ছেন না।
“রিকশায় যদি শাহবাগের লোকজন আনা নেওয়া করি, তাইলে যাওয়া আসার মাঝে কিছুক্ষণের জন্যও তো সমাবেশে থাকতে পারলাম।”
কেরাণীগঞ্জের একটি কোচিং সেন্টারে পড়ান শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বিরল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেক বলেন, “ইতিহাসের দায় থেকে আমি এখানে এসেছি। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যতোগুলো অভিযোগ ছিল, তার সবগুলোতেই তার একেকবার ফাঁসি হওয়া উচিত ছিলো।”
এই সমাবেশের উদ্যোক্তারা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শাহবাগে সমাবেশ করা হবে; আর শুক্রবার হবে মহাসমাবেশ।