সোমবার ঐতিহাসিক এই রায়ে জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-২।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন এই ট্রাইব্যুনাল রায়ের পর্যবেক্ষণে বলে, “যে নিপীড়ন ও নির্যাতন সয়ে, যে রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে একাত্তরে মুক্তি অর্জন করতে হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেই সময়ের বিশ্ব ইতিহাসে আর কোনো জাতিকে বোধ হয় লক্ষ্য অর্জনে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি।”
রায়ে বলা হয়, আবুল কালাম আযাদ একাত্তরে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনার করতেন। সে সময় তিনি জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মুজাহিদের বিরুদ্ধেও ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে।
১১২ পৃষ্ঠার রায়ের উপসংহারে বলা হয়েছে, “আসামি স্থানীয়ভাবে ‘রাজাকার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাজাকার বাহিনীর একজন সশস্ত্র কর্মী হিসেবে ফরিদপুরে দায়িত্ব পালন করতেন।”
জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি
ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের পর জামায়াত ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়ে উঠেছে।
আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “রায় ঘোষণার আগে আদালত স্পষ্ট করে বলেছে, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিল।”
তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশে এ সংগঠনের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের দাবি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, “এ রায় ৪০ বছরের আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ। মেজর জিয়াউর রহমান একাত্তরের খুনিদের পূর্নবাসন করেছিলেন।”
ঐতিহাসিক এ রায়ের মধ্য দিয়ে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরদার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যকরি সভাপতি মুনতাসীর মামুন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী আরেফ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা, তাদের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বলেন, “একটি ঐতিহাসিক রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। প্রসিকিউশন তাদের অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে।”
এই রায়ের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যশার পূরণ হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অবশ্য পলাতক আযাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান বলেন, আসামির পরিবারের সহযোগিতা না পাওয়ায় মামলায় ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব হয়নি।
‘আপিল চাইলে ধরা দিতে হবে আযাদকে’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিষ্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
“আইন অনুযায়ী, রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে আসামি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারবেন। তবে আবুল কালাম আযাদ পলাতক। তাকে ৩০ দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার করা না গেলে, অথবা তিনি আত্নসমর্পন না করলে তার আপিলের কোনো আবেদন পরে সুপ্রিম কোর্ট বিবেচনা করবে কি না- সেটা একান্তই সর্বোচ্চ আদালতের ব্যাপার।”
ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অনুযায়ী আযাদের ফাঁসির আদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শককে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে রেজিস্ট্রার জানান।
আসামি পালিয়ে বিদেশে গিয়ে থাকলে পুলিশ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ট্রাইব্যুনালে বিশেষ সতর্কতা
আবুল কালাম আযাদের যুদ্ধাপরাধের মামলার রায় ঘোষণার তারিখ থাকায় সকাল থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিশেষ সতর্কতা গ্রহণ করা হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রধান গেইটে কঠোর অবস্থান নেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
সাংবাদিক, আইনজীবী দর্শনার্থীসহ সবাইকে লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়। তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার আগে করা হয় তল্লাশি।
স্থান সঙ্কুলানের জন্য ট্রাইব্যুনাল-১ এর জন্য ব্যবহৃত কক্ষটিতে মামলার রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল- এর বিচারকরা। তারপরও অনেক মানুষকে দাঁড়িয়ে রায় শুনতে দেখা যায়।