প্রথম রায়ে আযাদের ফাঁসি

চার দশক আগে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামকে দমাতে ব্যাপক গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।

তানিম আহমেদ ও গোলাম মুজতবাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2013, 11:51 PM
Updated : 21 Jan 2013, 08:01 AM

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সোমবার ১১২ পৃষ্ঠার এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে এটিই প্রথম রায়।

পলাতক আযাদের বিরুদ্ধে আনা আটটি অভিযোগের মধ্যে সাতটিতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল প্রধান।

এর মধ্যে বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের সুধাংশু মোহন রায়, সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধব চন্দ্র বিশ্বাস ও ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ার চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা এবং বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামে লুটপাট- অগ্নিসংযোগের পর গণহত্যার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।  

এছাড়া ফরিদপুর শহরের খাবাশপুরের রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নিয়ে নির্যাতন, নতিবদিয়া গ্রামে দুই নারীকে ধর্ষণ এবং সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক হিন্দু তরুণীকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধ প্রমাণিত হলেও অন্য চার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ হওয়ায় এ তিন ঘটনায় নতুন কোনো শাস্তির আদেশ দেয়নি আদালত।

তবে আলফাডাঙ্গা থেকে ধরে এনে আবু ইউসুফ নামের এক ব্যক্তির ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় এই অভিযোগ থেকে আযাদকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

আযাদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক থাকায় এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে না বলে জানিয়েছেন তার পক্ষে ট্রাইব্যুনালের নিয়োগ করা আইনজীবী মো. আবদুস শুকুর খান।

ট্রাইব্যুনালের রেজিষ্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, রায়ের এক মাসের মধ্যে আপিল করার সুযোগ থাকলেও আত্মসমর্পণ না করলে বা ধরা না পড়লে আযাদ সে সুযোগ পাবেন না। 

ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অনুযায়ী আযাদের ফাঁসির আদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শককে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

অন্যদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “ঐতিহাসিক এই রায়ে জাতির আশা পূরণ হয়েছে।” 

২০০৯ সালের ২৫ মার্চ এই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর দুই ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত মোট নয়টি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়, যার মধ্যে আযাদের মামলার রায় হলো এবং আরো দুটি মামলা রায়ের পর্যায়ে রয়েছে।

জনাকীর্ণ আদালত

রায়ের তারিখ থাকায় পুরাতন হাইকোর্ট ভবন এলাকায় সকাল থেকেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। সাংবাদিক, আইনজীবী দর্শনার্থীসহ সবাইকে তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।

ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থান সংকুলান না হওয়ায় আদালত বসে ট্রাইব্যুনাল-১ এ। তারপরও অনেককে দাঁড়িয়ে রায় শুনতে দেখা যায়। 

আদালত শুরুর আগে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সবার সহযোগিতা চান। এরপর জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে তিনি রায় পড়া শুরু করেন। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারক শাহীনূর ইসলাম ও মো. মজিবুর রহমান মিয়াও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

রায়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আসামি আবুল কালাম আযাদকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এই দণ্ড কার্যকর করতে হবে। 

জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে ‘পাকিস্তান রক্ষার’ নামে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ তৈরির মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।

‘কলঙ্ক মোচন’

আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আজ একটি বিশেষ দিন। জাতির দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষা পূরণ হতে চলেছে। জাতির ললাট থেকে কলঙ্ক মোচন করতে চাই। সেজন্য সবার সহযোগিতা চাই।”

এ বিচার প্রক্রিয়া কেউ বন্ধ করতে পারবে না বলেও দৃঢ় প্রত্যয় জানান প্রধানমন্ত্রী।

আযাদের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মিছিল হয়েছে তার জেলা ফরিদপুর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। পলাতক এই আসামিকে ধরে এনে রায় বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে একাত্তরে নির্যাতিত পরিবারগুলো।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটি ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা সংগঠনগুলো রায়ে সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি দণ্ডাদেশ দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে।

এই রায় আশাবাদী করে তুলেছে খুরশিদ জাহান বেগমকেও। একাত্তরে পাঁচ মাসের শিশু সন্তান কোলে নিয়ে দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এই নারী।

তিনি বলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক- এটা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে শুধু আমার নয়, দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি... আমি আশা করব, এই রায়ের ধারাবাহিকতায় অভিযুক্ত অন্যরাও যার যার অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি পাবেন।”

আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও এ রায়কে স্বাগত জানিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করার প্রত্যয় জানিয়েছেন। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, “বাচ্চু রাজাকার যেখানেই থাকুক, তাকে ধরে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হবে।”

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান শরিক ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিএনপির ‘পূর্ণ সমর্থন’ থাকলেও তাতে ‘স্বচ্ছতা’ দেখতে চেয়েছে তারা।

মামলার সার সংক্ষেপ

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গত বছর ২ সেপ্টেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে, যাতে লুট, ধর্ষণ, হত্যা, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।

এতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র আযাদ ছাত্রসংঘের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৫ মার্চের কালরাতের পর তিনি সহযোগীদের নিয়ে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান।

গত এপ্রিলে আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও পুলিশ তার বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল গত ৯ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করতে বলে।

আযাদ পলাতক থাকায় এবং বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও হাজির না হওয়ায় গত ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তার অনুপস্থিতিতেই মামলার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়।

এরপর ৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আযাদের বিরুদ্ধে ৬ ধরনের ৮টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে সাতটিতে আযাদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় রায়ে।

রায়ে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ৫ মার্চ ফরিদপুরের বড়খাড়দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আবুল কালাম আযাদ রাজেন্দ্র কলেজে লেখাপড়া করেন। তিনি জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদেরও বিচার চলছে। 

আদালত বলে, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠনের আগ পর্যন্ত আযাদ পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন।

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল তিনি ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে’ ফরিদপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ‘অভ্যর্থনা’ জানান। আযাদ স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন এবং আলবদর বাহিনীরও প্রধান ছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে তিনি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস নির্যাতন চালান।

আযাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হলে তার পক্ষে শুনানি করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ২২ জন সাক্ষ্য দেন। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।

শুনানি শেষে গত ২৬ ডিসেম্বর এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। আর সোমবার আযাদের ফাঁসির রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে চল্লিশ বছরের অসমাপ্ত এই বিচার কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল।