সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা এক বছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে বুধবার সকালে ঢাকা সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীামা ৫৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করেছিলাম। গতকাল (মঙ্গলবার) আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের চাকরির বয়সসীমা আরো এক বছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করে দিয়েছি।”
সরকার গত বছর ডিসেম্বরে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করার পর অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমার পার্থক্য ঘুঁচে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের অবসরের বয়সসীমা আরো বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
এ বিষয়ে একটি রিট আবেদন হলে একটি রুল জারি করে হাই কোর্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমাও কেন অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে একই অনুপাতে বাড়ানো হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।
‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ সস্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬০ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীর হাতে চেক ও উপহার সামগ্রী তুলে দেন।
বীরশ্রেষ্ঠদের উত্তরাধিকারীদের চেক দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী নিজে গিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের মা মফিদুন নেসা এবং বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগমের হাতে উপহার তুলে দেন।
এ সময় মফিদুন নেসা ও মালেকা বেগম প্রধানমন্ত্রীকে আলিঙ্গন করেন এবং তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন। মালেকা বেগম প্রধানমন্ত্রীর কপালে চুমু দেন।
এরপর একে একে বীরউত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবধারীরা প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে উপহারসামগ্রী নেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান জাতি যেন যুগে যুগে স্মরণ এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের সম্মান করে সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।”
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির বিষয়ে ইতোমধ্যে সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধাদের ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সব তথ্যের পাশাপাশি তাদের পরিবার সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যও সংরক্ষণ করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতার পরিমাণ ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক দেড় হাজার টাকা হারে সম্মানী ভাতা দেওয়া হতো। এ ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা এবং ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেড় লাখে উন্নীত করা হয়েছে।
বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের মাসিক ভাতা ১১ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা এবং আড়াই হাজার শহীদ পরিবারের ভাতা পাঁচ হাজার ৮৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাত হাজার ২০ টাকা করার কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১০-২০১১ অর্থবছরে মোট সাত হাজার ৮৩৮ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারকে ৬১ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা দেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চলতি অর্থবছরে আমরা এই ভাতার পরিমাণ আরও শতকরা ২০ ভাগ বৃদ্ধি করেছি।”
মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে ১৪২ জন যুদ্ধাহত ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের মধ্যে ১৯৭২ সালের মতো প্রতীকী মূল্যে পরিত্যক্ত বাড়ি দেয়ার কথাও মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আবাসন সমস্যা রয়েছে। অনেকের সাথে কথা বললাম- আপনাদেরও একই অবস্থা।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন, সৎকার ও সমাধিস্থ করা বাবদ তাদের পরিবারকে অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে সরকারের নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথাও তিনি অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ১১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের সব জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।”
“দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশে ১২৯টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে”, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
উপজেলা পর্যায়ে ভূমিহীন ও অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাদের নিজস্ব বসতবাটিতে ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে আবাসন প্রকল্প উন্নয়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা জানান, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আগামী ১৫ ডিসেম্বর আরো কয়েকজন বিদেশি বন্ধুকে সম্মাননা দেওয়া হবে।
অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়া, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামূল বারী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ উজ জামান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল আবদুল ওয়াদুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সশস্ত্র বাহিনীর ক্রেস্ট তুলে দেন সেনাপ্রধান। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘বিশেষ অনির্বাণ’ এর ডিভিডি তুলে দেন নৌবাহিনী প্রধান। আর বিমানবাহিনী প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে দেন একটি জার্নালের কপি।
পরে প্রধানমন্ত্রী খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে চা চক্রে মিলিত হন।