‘৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার দরকার’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে একাত্তরে গণহত্যার বিচারের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন সায়মন ড্রিং, ওই সময়ে যিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা চিত্র বিশ্ববাসীর নজরে এনেছিলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2012, 11:48 AM
Updated : 20 July 2021, 12:37 PM

সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকার যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতা সায়মন ড্রিংয়ের পাশাপাশি একাত্তরে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা মার্ক টালিও একাত্তরের স্মৃতিচারণ করেন।

মার্ক টালি বলেন, একাত্তরে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশাল ভুল করেছিল।

সোনারগাঁও হোটেলে স্মৃতি ৭১ শিরোনামের এই অনুষ্ঠানে দুই বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহও।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, যাতে অংশ নেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, লেখক, অধ্যাপক, সচিবসহ বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।

পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞের খবর বিশ্ববাসীর কাছে প্রথম তুলে ধরা সাংবাদিক সায়মন ড্রিং বলেন, “৪০ বছর পর হলেও অপরাধের জন্য তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”

এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের ওপর চালানো গণহত্যার বিচার যে এখনো চলছে, তা তুলে ধরেন তিনি।

একাত্তরে বাঙালির ওপর নির্মমতার মাত্রা তুলে ধরে, এমন অনেক প্রতিবেদন রয়েছে বলে জানান ড্রিং।

মার্ক টালি বলেন, “আপনারা ব্যক্তির বিচার করছেন এবং এটা অবশ্যই প্রমাণিত হবে একজন ব্যক্তি কী করেছিল।”

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্যতস সংগঠক সফিউল্লাহ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।

একাত্তরে চিত্র তুলে ধরে মার্ক টালি বলেন, “আমার মতে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশাল ভুল করেছিল।”

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে প্রথম প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং বলেন, “আমি যত দূর জানি, ওই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এমন নয় যে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। কিন্তু তাদের (বাঙালি) শিক্ষা দিতে তারা এটা করেছিল।”

একাত্তরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সায়মন বলেন, ২৬ মার্চ সিদ্দিক নামে এক মেজর তৎকালীন তাকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল (এখনকার রূপসী বাংলা) হোটেল ছেড়ে যেতে বলেন।

“এটা কি নির্দেশ, আমি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না’। তবে নিজের নিরাপত্তার জন্য তোমাদের চলে যাওয়া উচিত।”

ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে যা ঘটছিল, তা হোটেলের ছাদ থেকে দেখেছিলেন টেলিগ্রাফের এই সাংবাদিক। তিনি জানান, ২৭ মার্চ মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্য ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে তাকে সহযোগিতা করেছিল।

অক্ষত অবস্থায় সবগুলো নোটবুক সঙ্গে নিয়ে সায়মন থাইল্যান্ড যান এবং ঢাকায় গণহত্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন, যা ৩০ মার্চ টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয়। বিশ্ববাসী জানে, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে।

মার্ক টালি বলেন, সায়মন যখন ঢাকা ছেড়ে যান তখন ঢাকায় আর কোনো বিদেশি সাংবাদিক ছিল না।

“আমি রাজশাহী গিয়েছিলাম এবং দেখেছিলাম সব গ্রাম আগুনে ভস্মীভূত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুরো দেশকে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করেছিল।”

বিবিসির এই সাংবাদিক বলেন, যখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যান তখন সেখানকার কেউ বিশ্বাস করেনি যে তাদের সেনাবাহিনী এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।

“আমি যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাই তখন আমাকে বলা হয়, বিবিসিকে এক পক্ষের সংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং অর্ধেক খবর সম্প্রচার করা হচ্ছে,” বলেন টালি।

যুদ্ধকালীন বস্তুনিষ্ট খবর প্রচার করায় বিরাগভাজন হয়ে ওই সময় পাকিস্তানিরা বিবিসিকে ‘ভারত ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’ ও ‘ব্রিটিশ বাকওয়াজ কর্পোরেশন’ নামে সম্বোধন করত বলে জানান তিনি।

যুদ্ধকালে পাকিস্তানি জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে তাদের সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের পক্ষেই প্রচারণা চলত। বিবিসি রেডিওতে মার্ক টালির পরিবেশিত খবর ছিল মানুষের সংবাদ জানার প্রধান উৎস।

পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সামরিক অভিযান নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে স্পষ্ট বিভাজন দেখা দিয়েছিল বলে জানান মার্ক টালি।

“কোনো পাকিস্তানি মনে করত, সামরিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। আর কারো বিশ্বাস ছিল শান্তিপূর্ণ সমাধানে,” বলেন তিনি।

একাত্তরের মার্চের শুরুতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তোলা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওই সময় নামিয়ে ফেলতেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখেছিলেন সায়মন ড্রিং।

“যখন আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম সেখানে বাংলাদেশের পতাকা নেই।”

একাত্তরের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বাংলাদেশের এগিয়ে চলা নিয়েও কথা বলেন দুই সাংবাদিক।

যুদ্ধক্ষতের কথা তুলে ধরে মার্ক টালি বলেন, যুদ্ধপরবর্তী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা অনেকে ভুলে যেতে পারেন। তখন অবকাঠামো ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।

“বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর অবকাঠামোর জন্য অর্থ সংগ্রহ, সংবিধান প্রণয়ন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলাসহ অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল।”

“বাংলাদেশ এসব সমস্যা পেরিয়ে লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে,” বলেন টালি।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর এবং পরের মাসে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার সময় ঢাকায় অবস্থানকারী সায়মন ড্রিং বলেন, “তখন কোনো অবকাঠামো ছিল না। এটা ছিল বিশাল কাজ। এটা ঠিক করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।”

“৪০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেছে,” পর্যবেক্ষণ এই সাংবাদিকের।

স্মৃতিচারণের এই অনুষ্ঠান সাজানো ছিল গান ও আবৃত্তিতেও, যা সরাসরি স¤প্রচার করে দেশ টিভি। অনুষ্ঠানটি দেখা যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ওয়েবসাইটেও।

স্মৃতি ৭১ অনুষ্ঠান আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করে ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠী মোহাম্মদী গ্রুপ ও হা-মীম গ্রুপ।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই বিদেশি সাংবাদিকের স্মৃতিচারণা নবীন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

এই ধরনের অনুষ্ঠান করার পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারের কৃতিত্ব দাবি করে তিনি বলেন, “দেশে অনুকূল পরিবেবেশের কারণে এ ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্বাধীনতার ৩০ বছর, ৩৫ বছর গেল, কিন্তু ৪০ বছরে এসে আজ আমরা মুক্তিুযদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানাচ্ছি, স্মৃতি একাত্তরের মতো সুন্দর অনুষ্ঠান হচ্ছে।”

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে স্মৃতি বলতে নারাজ ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে ‘অগ্নিকন্যা’ বলে পরিচিতি পাওয়া মতিয়া।

“আমাদের কাছে এখনো একাত্তর জীবন্ত,” বলেন তিনি।

অনুষ্ঠানের সার্বিক মানে সন্তোষ প্রকাশ করলেও আওয়ামী লীগের এই নেত্রী বলেন, ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় তাদের কথা তর্জমার ব্যবস্থা থাকলে আরো ভালো হতো, দর্শনার্থী ও টেলিভিশনের দর্শকরা সহজেই প্রশ্ন করতে পারত।

আয়োজকদের অন্যতম মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুল হক পুরো অনুষ্ঠান নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

“আমি খুবই খুশি। আমার মতো একজন সাধারণের ডাকে দুই স্বনামধন্য সাংবাদিক সবার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতা আমি সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি,এ জন্য আমি ধন্য।”

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদও দেড় ঘণ্টার এই অনুষ্ঠান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানান মোহাম্মদী গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক। মূলত এই আয়োজনের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন তিনিই।