শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে একটি বাসের সংঘর্ষ হলে ঘটনাস্থলেই পাঁচ জনের মৃত্যু হয় বলে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
দুর্ঘটনায় নিহত বাকি তিনজন হলেন, মাইক্রোবাসের চালক মুস্তাফিজ, তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল।
তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেকের প্রোডাকশন ইউনিটের সহকারী সাইদুল ইসলামও আহত হন এ দুর্ঘটনায়। তাদের রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের ভর্তি করা হয়েছে।
নিহত ৫ জনের মরদেহ সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসি) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু জানান, রাতে লাশ রাখা হবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের হিমঘরে। সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মরদেহ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া তারেক মাসুদের সহকারী মনিস রফিক জানান, তারা ভোর ৬টার দিকে লোকেশন দেখতে মানিকগঞ্জে যান। ফেরার পথে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সেখানেই মারা যান তারেক ও মিশুক।
দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "প্রাথমিকভাবে জেনেছি, তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি একটি বাসের পেছনে পেছনে যাচ্ছিল। বাসটিকে ওভারটেক করার সময় বিপরীত দিক থেকে আরেকটি বাস আসলে সংঘর্ষ হয়।"
তিনি বলেন, "এভাবে ওভারটেক করা ঠিক হয়নি। রাস্তা বা সিগনালের কারণেও এ দুর্ঘটনা ঘটেনি। তারপরও আমরা তদন্ত করে দেখছি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
মুক্তির গান ও মাটির ময়না চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের নতুন ছবি 'কাগজের ফুল' এর 'লোকেশন' দেখতে মানিকগঞ্জ যায় দলটি। সেখান থেকে ফেরার পথেই এ দুর্ঘটনা ঘটে।
তারেক ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন অভিওভিশন নামের একটি প্রোডাকশন হাউজ পরিচালনা করেন। এই দম্পতির পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত 'মাটির ময়না' কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীর দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। একুশে টেলিভিশন চালু হওয়ার সময় হেড অব অপারেশন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, চ্যানেল ফোর ও সিবিসি টেলিভিশনের ক্যামেরা অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। গত বছর দেশে ফিরে এটিএন নিউজের সিইওর দায়িত্ব নেন।
তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদও একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক। ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি দুজনেই চিত্রশিল্পী হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে পরিচিত মুখ।
তারেকের মামা জুলু চৌধুরী জানান, তারেক ও ক্যাথরিনের দেড় বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া, যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
জানাজা রোববার দুপুরে
সন্ধ্যা ৬টা ৪০ এর দিকে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিহত পাঁচজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পৌঁছালে সেখানে উপস্থিত এটিএন নিউজের সংবাদ কর্মী, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সাংবাদিকদের জানান, মরদেহের ড্রেসিং শেষে গোসল করানো হয়।
লাশের ময়না তদন্ত করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
"মেডিকেলের আনুষ্ঠানিকতা সেরে মিশুক মুনীরের মরদেহ তার বনানীর বাসায় এবং তারেক মাসুদের মরদেহ ফার্মগেটে তার বোনের বাসায় নেওয়া হয়। রাতে লাশ রাখা হবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের হিমঘরে।"
রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় মিশুক মুনীরের মরদেহ কারওয়ান বাজারে এটিএন বাংলা ভবনের সামনে রাখা হবে। সেখানে তার সহকর্মীরা শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন। মিশুক ও তারেকের কফিন সকাল সাড়ে ১০ থেকে ১২টা পর্যন্ত রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর এই অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের জনগণ শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন।
বাচ্চু জানান, এই দুই জনের জানাজা হবে রোববার জোহরের পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। তবে দাফনের বিষয়ে শনিবার রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, "ক্যাথরিন একটু সুস্থ হলে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মিশুক মুনীরের ভাই আসবেন বিদেশ থেকে। দাফনের বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।"
তারেক মাসুদের ছোট ভাই নাহিদ মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ঢাকা মেডিকেল থেকে সন্ধ্যার পর ভাইয়ার লাশ বাসায় আনা হয়েছিল। কিছু সময় পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।"
দাফনের বিষয়ে ক্যাথরিনই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।