‘নিরাপদ’ ট্রেনে প্রতি মাসে ডাকাতি

পাথর ছুড়ে অথবা ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাইপ খুলে দিয়ে চলতি বছর ২৪ বার ডাকাতি বা ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন ট্রেনে।

মো. মহিউদ্দিন প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2011, 07:35 AM
Updated : 12 August 2013, 07:58 PM

বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ‘নিরাপদ যাত্রার বাহন’ শ্লোগান নিয়ে যাত্রীসেবার কথা বললেও চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে ১১ বার ট্রেন ডাকাতি হয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে।

পাথর ছুড়ে অথবা ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাইপ খুলে দিয়ে ট্রেন থামিয়ে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে আরো অন্তত ১৩ বার। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ডাকাতি ঠেকাতে বা যাত্রীদের নিরাপত্তায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না রেল পুলিশ।

ডাকাতদের হাত থেকে রেহাই পায়নি অর্থমন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেনও। ডাকাতদের হাতে মালামাল খুইয়েছেন, আহত হয়েছেন বহু যাত্রী। ছিনতাইকারীদের টানে ট্রেন থেকে পড়ে একজন নিহতও হয়েছেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট লাইনে বার বার ডাকাতির ঘটনায় আস্থা হারাচ্ছেন যাত্রীরা। এতে করে বাংলাদেশ রেলওয়ে যে ‘ভাবমূর্তি’ সঙ্কটে পড়ছে, তা স্বীকার করছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহা ব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নিরাপত্তার বিষয়টি রেল পুলিশ দেখবে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন শাখার প্রধান সহকারী কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে চারটি, ফেব্র“য়ারিতে একটি, মার্চে দুটি, এপ্রিলে দুটি, মে মাসে তিনটি, জুনে চারটি, জুলাইয়ে একটি, অগাস্টে চারটি, অক্টোবরে একটি এবং নভেম্বর দুটি ডাকাতি বা ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে।

যেভাবে থামানো হয় ট্রেন

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা জানান, ডাকাতির জন্য ট্রেন থামানোর ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের সবচে বড় অস্ত্র হলো পাথর। চলন্ত ট্রেনের জানালায় বা ইঞ্জিন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে ট্রেন থামানো হয়। এরপর ট্রেনে উঠে পড়ে সশস্ত্র ডাকাতরা।

আবার কখনো কখনো ট্রেনে থাকা ডাকাতরা চেইন টেনে অথবা দুই বগির মাঝখানে ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাইপ খুলে ট্রেন থামিয়ে দেয়। তারপর যাত্রীদের মালামাল লুটে নিয়ে পালিয়ে যায়।

ইঞ্জিন কারে ঢুকে চালক ও সহকারীকে ছুরি মেরে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে বলে রেল কর্মকর্তারা জানান।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিবহন কর্মকর্তা (সিওপিএস) বেলাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডাকাতরা ট্রেন থামিয়ে লুটপাট চালানোর সময়ও বাইরে থেকে বগিতে পাথর ছুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে, যাতে যাত্রীরা এগিয়ে না আসে।”

এভাবে ট্রেন থামিয়ে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ বার ডাকাতি হয়েছে।

বেলাল জানান, প্রতিবার ডাকাতি হওয়ার পর আহত যাত্রীদের চিকিৎসা দিয়ে এবং ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাইপ ঠিক করে গন্তব্যে পৌঁছাতে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি হয়ে যায়।

জানালা ভেঙে পাথর

নভেম্বরের ১৫ তারিখ ছেলে ইয়ামনকে নিয়ে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ডাকাতদের ছোড়া পাথরে আহত হন মিরপুরের বাসিন্দা মমতা হক (৪০)।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার সিট ছিল জানালার পাশে। জানালার কাচ তোলা ছিল। চিনকি আস্তানার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে একটা পাথর এসে আমার ডান চোখে লাগে। চশমা ভেঙে কাচ চোখে ঢুকে যায় চোখে।”

চিকিৎসা করানো হলেও ডান চোখে এখন আর ভালো দেখতে পান না মমতা।

ওই ঘটনার ঠিক আগের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঘাচং এলাকায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস লক্ষ করে পাথর নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা।

প্রধান পরিবহন কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন জানান, মাস তিনেক আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তার ব্যাগ ছিনতাই হয় চলন্ত ট্রেনে। এতে গহনা, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা মিলিয়ে তার প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

মন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেনও আক্রান্ত

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৈরি করা ‘দুস্কৃতকারী কর্তৃক পাথর নিক্ষেপ সংক্রান্ত অপ্রীতিকর ঘটনার বিবরণী’ থেকে জানা যায়, গত ৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে বহনকারী একটি ট্রেনও ডাকাতদের কবলে পড়ে।


বিবরণীতে বলা হয়েছে, “সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের চারটি কোচের (বগি) হোস পাইপ খুলে ট্রেন থামিয়ে ডাকাতির চেষ্টা করা হয়। উক্ত ট্রেনে ভ্রমণরত মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসএসএফের সহায়তায় গার্ড, এলএম ও ক্যারেজ অ্যাটেন্ডেন্ট কর্তৃক হোস পাইপ পুনঃসংযোজন পূর্বক ট্রেনটি ছেড়ে যায়।”

‘ক্রাইম জোন’

বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা বলছেন, কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপ ও ডাকাতির ঘটনা তুলনামূলক বেশি ঘটছে।

এ এলাকাকে তারা ‘ক্রাইম জোন’ (অপরাধপ্রবণ এলাকা) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ পথের বিভিন্ন অংশেই এসব ঘটনা বেশি ঘটে।

পরিবহন শাখার কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেলপথের নানা অংশে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় এটি বেশি অপরাধপ্রবণ। বর্তমানে এলাকাটি ক্রাইম জোন হয়ে উঠেছে।”

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ ও এপ্রিলে আখাউড়া ও গঙ্গাসাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় ট্রেনের ইঞ্জিন কক্ষে ঢুকে চালক ও সহকারীকে ছুরি মেরে দুটি ডাকাতি হয়েছে।

রেল পুলিশ ‘নিরব’

ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের সময় ট্রেনে রেলওয়ে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কোনো ভূমিকা রাখেন না বলে অভিযোগ করেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে তারা ব্যক্ত করেছেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।

প্রধান পরিবহন কর্মকতা বেলাল উদ্দিন বলেন, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মোট দুই হাজার রেল পুলিশ আছে। রেলওয়ে থেকে সব ধরনের সুবিধা নিলেও সঙ্কটের সময় তারা কোনো কাজে আসে না।

“যাত্রীদের নিরাপত্তায় তারা কিছুই করতে পারে না। অনেক দুর্ঘটনার সময়ই পুলিশ উপস্থিত ছিলো। কিন্তু তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।”

এ পর্যন্ত কোনো ডাকাতির ঘটনায় রেল পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারেনি বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

লোক সংকটে অসহায়’

রেলওয়ে পুলিশের চট্টগ্রামের সুপার হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লোকবল সংকটের কারণে সবসময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

“প্রতিটি আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনে ১৯ থেকে ২০টি কোচ (বগি) থাকে। এর নিরাপত্তার দায়িত্ব রেল পুলিশের ৬ সদস্যের ওপর। পাকিস্তান আমলের এ লোকবল নিয়ে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।”

যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রতি কোচে অন্তত একজন করে পুলিশ থাকা দরকার বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

ঘটনার পর রেল কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি রেল পুলিশকে জানায় না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।