'ভুয়া' সমর্থন তালিকা রোধে নতুন বিধিমালা

স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আসনের এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন সম্বলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও নবম সংসদ নির্বাচনে অনেকেই তা মানেননি। সমর্থক সংখ্যার চেয়ে অনেক কম ভোটও পেয়েছেন কেউ কেউ। এমন অবস্থায় সমর্থনের ভুয়া তালিকা রোধে নতুন বিধিমালা করছে নির্বাচন কমিশন। মঈনুল হক চৌধুরীর প্রতিবেদন

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2010, 10:57 PM
Updated : 28 Oct 2010, 10:57 PM
মঈনুল হক চৌধুরী
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
ঢাকা, অক্টোবর ২৯ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- নবম সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জয়নুল আবদীন সরকার। ওই আসনের মোট ভোটার দুই লাখ ৪৩ হাজার ৬৭ জন। তাদের প্রায় আড়াই হাজারের স্বাক্ষরসহ সমর্থনের তালিকা নির্বাচন কমিশনে জমা দিলেও নির্বাচনে তিনি তালা প্রতীকে পান মাত্র ১৪৬ ভোট।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তদন্তে আরো দেখা গেছে, পাবনা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ইয়াসিন আরাফাত মনোনয়নে দাখিলকৃত সমর্থন তালিকায় একই ব্যক্তির একাধিক স্বাক্ষর নেন। স্থানীয় তদন্তে অনেকেই তাতে স্বাক্ষর করেননি বলে লিখিতভাবে জানান।
একজন প্রার্থী সমর্থিত ভোটারদের ভোটও না পাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের পরে স্বল্প সময়ে এতো ভোটারের স্বাক্ষর যাচাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় ইসি শুধু ১০টি স্বাক্ষর যাচাই করে। এ অবস্থায় জাল বা ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে নির্বাচনে ডামি প্রার্থী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে এক শ্রেণীর স্বতন্ত্র প্রার্থী।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের সমর্থন নিয়ে 'ভুয়া তালিকা' জমা দেওয়া রোধে কঠোর উদ্যোগ নিচ্ছে ইসি। এ লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রার্থিতার পক্ষে সংযুক্ত করা ভোটারদের স্বাক্ষর যাচাই সংক্রান্ত বিধিমালা-২০১০ প্রণয়ন করা হচ্ছে।
বুধবার নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার সংখ্যার এক শতাংশের সমর্থন সম্বলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
নবম সংসদ নির্বাচনের আগে এমন বাধ্যবাধকতা রাখার পর তা যাচাই করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের দিয়ে। কোন পদ্ধতিতে, কারা এই যাচাইয়ের কাজ করবেন- তা নির্ধারণ করে এবার ওই আইনে নতুন বিধিমালা যুক্ত করা হবে।
প্রস্তাবিত বিধিমালা নিয়ে কমিশন সভায় আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, "প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা যাচাইয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে নতুন বিধি যুক্ত করা হবে। সেই সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থনে ভোটারদের ভুয়া স্বাক্ষর সংগ্রহ ঠেকাতেও যাচাই বিধি যুক্ত হবে।"
যোগ্য প্রার্থীদের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসি আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও জানান সাখাওয়াত হোসেন।
স্বতন্ত্রের হিড়িক রোধে
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হিড়িক পড়েছিলো। কোনো ধরনের বিধিনিষেধ না থাকায় যে কেউ অংশ নিয়েছেন। এমনও হয়েছে, দলীয় প্রার্থীদের তুলনায় প্রায় এক পঞ্চমাংশ প্রার্থী ছিলেন স্বতন্ত্র।
এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্বাচনী আইনে ব্যাপক সংস্কার আনে।
নবম সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসহ স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধান যুক্ত করার পর ২১০ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। তা যাচাইয়ের পর ১৪১ জন চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হন। তারা ভোট পেয়েছেন ২০ লাখ ৫১ হাজার ১৪৫টি, যা মোট ভোটের ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
নির্বাচনে চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন।
এ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনে ১২০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নেন।
এরপর ১৯৭৯ সালে ২৮ ফেব্র"য়ারি, ১৯৮৬ সালের ৭ মে, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্র"য়ারি, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র"য়ারি ও একই বছরের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদে ৪৪২ জন, তৃতীয় সংসদে ৪৫৩ জন, চতুর্থ সংসদে ২১৪ জন, পঞ্চম সংসদে ৪২৪ জন, ষষ্ঠ সংসদে ৪৫৭ জন, সপ্তম সংসদে ২৮১ জন, অষ্টম সংসদে ৪৮৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
অর্ধশতাধিকের মনোনয়নপত্র বাতিলের রকমফের
সাতক্ষীরা-২ আসনের কাজী হেদায়েত হোসেনের প্রার্থিতা বাতিল হয় গত নির্বাচনে। কারণ হিসেবে ইসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসি দ্বৈবচয়ন (র‌্যানডম) ভিত্তিক ১০টি ভোটার ক্রমিকের (২০২১, ২০৫৫, ২৩২৬, ১২৯৭, ১৬৬২, ১৫৬৯, ১০৯৩, ১৯০৯, ৩১১ ও ২৫২) বিষয়ে সরেজমিন যাচাই করে।
তাতে দেখা যায়, ১২৯৭ ক্রমিকের ভোটার মো. আব্দুর রশিদ (ছোটবাবু) ছাড়া অন্য কেউ কাজী হেদায়েত হোসেনের মনোনয়নে সমর্থন করেননি।
বাগেরহাট-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোল্লা আ. রউফ এর প্রার্থিতাও বাতিল হয় জাল দলিলের কারণে। তিনি ওই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাবিবুন নাহারের সমর্থকদের তালিকা নিজের সমর্থনে দাখিল করেন। বিষয়টি ইলেকশন মনিটরিং অফিসার শেখ মো. শাহাদৎ আলীর তদন্তে প্রমাণিত হয়।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল হুদা মুকুটের দাখিল করা ১ শতাংশ ভোটারের নমুনা স্বাক্ষরের মধ্যে ১০টি পরীক্ষা করে সাতটিতে মিল না পাওয়ায় বাতিল করা হয় তার মনোনয়নপত্র।
পাবনা-১ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শরীফুল ইসলাম দুই লাখ ৯৫ হাজার ৫৬৪ ভোটারের বিপরীতে ১,৩৭৮ ভোটারের সমর্থন তালিকা জমা দেন। ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে তার প্রয়োজন ছিলো ২,৯৫৬ জনের সমর্থন।
এভাবে ভোটারের সমর্থন যথাযথ না হওয়ায় ও স্বাক্ষর জাল করায় ও ১ শতাংশ সমর্থন সংগ্রহ করতে না পারায় প্রায় অর্ধ শতাধিক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
ইসি সচিবালয়ের যুগ্মসচিব (আইন) এন আই খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য একটি বাধ্যবাধকতা দেওয়া হলেও তা কার্যকর করার পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট ছিলো না। একটি অফিস আদেশে তা যাচাই করা হতো।
নতুন বিধিমালায় যাচাইয়ের পদ্ধতি, কে করবে, কত স্বাক্ষর বা ভোটারের সমর্থন যাচাই হবে- সব বিষয় সুনির্দিষ্ট থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, "প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে নয়, বরং তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা বাড়াতে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।"
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএইচসি/এজে/কেএমএস/১০৫২ ঘ.