ঢাকা, জানুয়ারি ১০ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- পটুয়াখালী জেলা শহরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল হাই এর কাছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে গত বছরের সব অর্জনই ম্লান মনে হয়। তার ভাষায়, "এক বছর আগে যেখানে ২০ টাকা করে চাল খেতাম, এখন তা ৩৫ টাকারও বেশি। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে ভাবার সময় কই।" জরুরি অবস্থার এক বছর পূর্তির ঠিক আগ মুহূর্তে আব্দুল হাই এর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল দেশের প্রায় সব এলাকা থেকেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের অনেকটাই যেন ঢেকে দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে লিখছেন মুনিরুল ইসলাম।
রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষণা জনমনে স্বস্তি এনে দেয়। নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক কার্যক্রম সাধারণ মানুষের মধ্যে আশারও সঞ্চার করে। কিন্তু দিন যত গড়াতে থাকে প্রত্যাশার বেলুন ক্রমেই যেন চুপসে আসে- মন্তব্য নোয়াখালীর উন্নয়ন সংগঠক আব্দুল আউয়ালের। তিনি বলেন, "মানুষের প্রত্যাশা ছিল, সরকার সফল হবে। বছর শেষে হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির অনেক ফারাক।"
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। দুর্নীতির অভিযোগে জনপ্রতিনিধিসহ এত দিন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা অনেককে গ্রেপ্তার অভিনন্দিতও করে সাধারণ মানুষ। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি কমে যাওয়ায় স্বস্তিও আসে।
কুষ্টিয়ার শিক্ষাবিদ রুহুল ইসলাম বলেন, "এ সময়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কতিপয় অসাধু রাজনীতিবিদ, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীর কাছে আমরা জিম্মি ছিলাম। জরুরি অবস্থার পর তা থেকে মুক্তি পেয়েছি।"
দুই দফা বন্যা, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় এ সময় দেশের মানুষকে। বন্যার পরপরই আগস্টে দেওয়া সরকারের পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, সাত লাখ ৫৫ হাজার ৪৭ একর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট এবং সাত লাখ ৬২ হাজার ৬৫৩ একর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২০৯ কোটি টাকা। বন্যায় মারা যায় পাঁচ শতাধিক মানুষ। নভেম্বরে সিডরের আঘাতে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়, লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে উপকূল এলাকা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই নেমে আসে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির খাঁড়া। বিশেষ করে চাল, আটা, গুঁড়ো দুধ আর ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি নাভিঃশ্বাস তোলে জনজীবনে। রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনের হিসাবে গত এক বছরে মোটা চালের দাম ৭০ শতাংশ বেড়েছে। আটার দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ; সয়াবিন তেল ও পামওয়েলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৪৬ ও ৬৬ শতাংশ।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় প্রায় সারা বছরই মানুষের অসন্তোষ ছিল। বছর শেষে চালের দাম হু হু বাড়লে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। সারাদেশে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব একটা তৈরি হয়নি। উল্টো দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির গ্রেপ্তার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনিশ্চয়তায় ফেলেছে।
তবে নতুন বছরের শুরুতে ন্যায্য মূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত স্বাগত জানায় মানুষ। এছাড়া বিডিআরের উদ্যোগে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি আর যৌথবাহিনীর উদ্যোগে 'চাষী বাজার' সীমিত আয়ের মানুষকে উপকৃত করেছে। তবে মধ্যবিত্তের সঙ্কট বেড়েছে।
খুলনার বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তফা কামাল বলেন, "সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে চাল নিতে গেলে তো চাকরি ছাড়তে হবে। তাই বাজার থেকে বেশি দামে চাল না কেনা ছাড়া আমাদের তো উপায় নেই। আমাদের সমস্যা দুই দিকেই। অভাবের কথা বলতেও পারি না। আবার সইতেও পারি না।"
এদিকে ৯ জানুয়ারি থেকে খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরু হলেও জেলাগুলোতে মজুদ কম থাকায় ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখা, টিআর খাতে চাল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যেমন ভোলা জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবু তারিক জানান, বিভিন্ন খাতে সরবরাহের জন্য চলতি জানুয়ারি মাসে ভোলায় ৬ হাজার ৪১ টন চালের চাহিদা রয়েছে। অথচ গুদামে মজুদ রয়েছে ২৫০০ টন চাল। ফলে অন্য খাতগুলোর চেয়ে ওএমএসকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
সার সঙ্কট পুরোটা সময়েই অস্থির করে রাখে কৃষকদের। বন্যা পরবর্তী উত্তরাঞ্চলে সার বিতরণে সবচেয়ে বেশি অব্যবস্থাপনা দেখা যায়। সার সঙ্কটের পাশাপাশি নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামে ফসলের ক্ষেতে পোকার আক্রমণও উৎপাদন ব্যাহত করে।
সারের জন্য কৃষকদের রাস্তা অবরোধ, ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন স্থানে। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও সার না পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে দিনাজপুরের প্রবীণ সমাজসেবী খতিব উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, "সার বিতরণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। কৃষকরা যাতে সরাসরি সার পায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু সারের জন্যই যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তবে ক্ষেতে কাজ করবে কখন।"
তবে জরুরি অবস্থা জারি কিংবা রাজনৈতিক পালাবদলের চেয়ে সার সঙ্কট আর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিই উৎকণ্ঠিত করে রাখে গ্রামীণ জনপদ। লক্ষ্মীপুরের উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামের কৃষক সগীরুল হক বলেন, "সার আর বীজটা যেন ঠিকমতো পাই, এটাই চাই। তাহলে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবো। আর জিনিসপত্রের দাম যেন কম থাকে।"
দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার আর সারাদেশে যৌথবাহিনী মোতায়েন বিভিন্ন সংস্থায় কার্যক্রমের সক্রিয়তা বাড়ায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনহয়রানিও কমে আসে।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার দোকানি শাহ আলম বলেন, "আগে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার পাইতাম না। এখন পাই।" একই কথা খাটে অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।
তবে হকার ও বস্তি উচ্ছেদ নিরাশ্রয় করে নিম্ন আয়ের মানুষকে। নোয়াখালী জেলা শহরে উচ্ছেদ হওয়া হকার আব্দুল হালিম বলেন, "আমরা যামু কই কন। কাম নাই, জিনিসপত্রের নাম যেন আগুন। রাস্তার পাশে খাড়াইয়া বেচা-বিক্রি কইরতাম। এহন সেটাও বন্ধ।"
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বস্তি ও হকার উচ্ছেদ অনেককেই জীবিকার উৎসচ্যুত করে। ফলে তারা অপরাধের দিকে ঝুঁকেছে।
হকার উচ্ছেদ অপরাধ প্রবণতা একটু বাড়িয়েছে বলে স্বীকার করলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এম আকবর আলীও।
তবে সামগ্রিকভাবে অপরাধ কমেছে দাবি করে আকবর আলী বলেন, "মামলা বেড়েছে ঠিক। তবে এর মানে এই নয় যে অপরাধ বেড়েছে। এখন মানুষ স্বস্তিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারস্থ হতে পারছে।"
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, ২০০৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন অপরাধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৩৯টি। ২০০৬ সালের পুরো সময় মিলিয়ে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৫৭৮টি।
জরুরি অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় দলগুলোর হানাহানি ছিল না। গ্রেপ্তার কিংবা গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দেয় অনেকে। গত কয়েকবছর ধরে দেশে জঙ্গি তৎপরতা চললেও জরুরি অবস্থার মধ্যে শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তাতে ভাটা দেখা যায়। তবে এর মধ্যে গত ৩ মে ঢাকার কমলাপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম রেল স্টেশনগুলোতে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিদ্যুৎ সঙ্কটে লোডশেডিংয়ের হাত থেকে রেহাই মেলেনি। অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলেছে সারাদেশে।
দ্রব্যমূল্য ছাড়া সরকারের অন্য কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দিনাজপুরের বাসিন্দা বিডিআরের সাবেক মহা পরিচালক ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, "নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি আইন-শৃঙ্খলা, বিচার বিভাগ পৃথক করা, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সক্রিয় করাসহ সরকারের সব সাফল্য ঢেকে দিয়েছে।"
সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল উল্লেখ করে নোয়াখালী নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আউয়াল বলেন, "সাধারণ মানুষের জীবিকায়নের ব্যবস্থাসহ যেসব ক্ষেত্রে দলীয় সরকারগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল সে সব ক্ষেত্রে ১১ জানুয়ারি পরবর্তী সরকার সফলতা দেখাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও তা হয়নি।"
তারপরও মানুষের প্রত্যাশা যেন ভেস্তে না যায় সেজন্য সরকারের ওপর ভরসা রাখতেই চাইছেন বগুড়ার নাট্যজন গোলাম কাদের।
তিনি বলেন, "আমরা ভীষণভাবে আশান্বিত হয়েছিলাম। বর্তমান অবস্থায় কিছুটা হতাশ। তবুও আশা রাখছি, সরকার আমাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে না।"
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/প্রতিনিধি/এমসি/এমআই/এমএ/২০৩৫ঘ.