সিভিক সেন্টারের নকশা: আয়োজক যখন প্রতিযোগী, মূল্য দিল উত্তর সিটি

নিয়ম ভেঙে আয়োজক কমিটির সদস্য নিজেই অংশ নেন প্রতিযোগিতায়, প্রথম পুরস্কারও পেলেন, তার নকশাতে ভবন নির্মাণের ঘোষণাও এল। তবে শেষ রক্ষা হল না- পুরস্কার হারালেন, শাস্তির মুখেও পড়লেন সেই স্থপতি; তার সঙ্গে যেন ‘মূল্য দিতে’ হল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকেও।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2022, 06:06 PM
Updated : 21 July 2022, 06:06 PM

আয়োজক হয়েও ওই স্থপতির প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ‘কারসাজি’র ঘটনা সামনে আসার কারণে নকশা চূড়ান্তের প্রক্রিয়াই থমকে গেছে। এতে পিছিয়ে গেছে দেশের প্রথম ‘সিভিক সেন্টার’ নির্মাণে উত্তর সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপটি।

অনেক দেশের মত রাজধানীতেও ২০ তলা একটি সিভিক সেন্টার গড়ে তুলতে চায় ঢাকা উত্তর সিটি। এজন্য গুলশান ২ নম্বরে বর্তমান ডিএনসিসি মার্কেটের জায়গাটি বাছাই করা হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা ওই ভবনের স্থানে সিভিক সেন্টারের পাশেই ৩০ তলা ডিএনসিসি টাওয়ার নির্মাণে এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও নিয়েছে উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। এর অর্থায়ন আসবে দেশের প্রথম মিউনিসিপ্যাল বণ্ড থেকে, যা পুঁজিবাজারে ছাড়তে প্রক্রিয়াও চলছে।

জোড়া এ ভবনের নকশা নির্বাচন প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কারজয়ী স্থপতির কেলেঙ্কারির কারণেই যা এখন আটকে আছে।

এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও ওই ভবনের ড্রয়িং পাই নাই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। একটা ড্রয়িং দিয়েছে সেটা আবার বাতিল করতে বলছেন, ওটা নিয়ে না কি কী কারসাজি হয়েছে? উনাদের (স্থপতি ইনস্টিটিউট) কারণে কাজটি শুরু করতে আমরা অনেক পিছিয়ে গেলাম।”

ভিন্ন ঘরানার ভবন তৈরির এ প্রকল্পের নকশা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করতে স্থপতিদের সংগঠন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (আইএবি) সঙ্গে চুক্তি করে উত্তর সিটি। ৩৯ জন স্থপতি ও স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া নকশা জুরি বোর্ডের মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করে বিজয়ী চূড়ান্তও করা হয়। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আয়োজিত অনুষ্ঠানে পুরস্কারও তুলে দেওয়া হয় বিজয়ীর হাতে; ঘোষণা দেওয়া হয় তার ওই নকশাতেই হবে ভবন দুটি।

বিপত্তি বাধে এর পরই। ওই অনুষ্ঠানের পর স্থপতিদের মধ্যে থেকে অভিযোগ ওঠে পুরস্কার জয়ী স্থপতি মো. শরীফ ইউ আহমেদ আয়োজক কমিটিতে থেকেও নিজে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।

এরপর তদন্তে নেমে আইএবি ঘটনার প্রমাণও পায়। ইনস্টিটিউটের সদস্য শরীফ ইউ আহমেদ ওই নকশা প্রতিযোগিতার জন্য গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন। এ অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত শেষে গত ১১ জুন ওই স্থপতির অংশগ্রহণ এবং তার প্রথম পুরস্কার বাতিল করে আইএবি।

দেওয়া হয় শাস্তিও; যাতে আইএবির সদস্য ও স্থাপত্য নকশা তৈরির প্রতিষ্ঠান স্থাপতিক এর প্রধান স্থপতি শরীফ ইউ আহমেদ আগামি পাঁচ বছর কোনো নকশায় সই করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন আইএবির সভাপতি স্থপিত মোবাশ্বের হোসেন।  

এই নকশাটি প্রথম হয়েছিল, তবে তার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রতিযোগিতার ফলাফল নিয়ে এ কেলেঙ্কারির কারণে আটকে গেছে ডিএনসিসির প্রকল্পটিও। ভবনের নকশা পেতে তিন দফা চিঠি দেওয়ার পরই যা জানতে পারে নগর কর্তৃপক্ষ।

আইএবি সভাপতি বলেন, পুরস্কার ঘোষণার দুদিন পর আরও কয়েকজন প্রতিযোগী বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করলে অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ে।

“কমিটির সদস্য হিসেবে সে (শরীফ ইউ আহমেদ) অনেকগুলো মিটিংয়ে ছিল। ফলে প্রতিযোগিতার অনেক বিষয়ে আগেই সে তথ্য পেয়ে যায়। অনেকটা প্রশ্ন ফাসেঁর মত। সে এটা ইনটেনশনালি করেছে। তার নাম ঘোষণা করার পরই বিষয়টি বোঝা গেছে। রুলস ভায়োলেশন করায় আমাদের ডিসিপ্লিনারি কমিটি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।”

ফল ঘোষণার ছয় মাস পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পুরস্কার ঘোষণার দিন বিষয়টি নজরে আসেনি। অভিযোগ পাওয়ার পর ইনস্টিটিউটের শৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটি বিষয়টি তদন্ত করেছে। কমিটি ১৪টি সভা করেছে, শুনানি হয়েছে। সবশেষে কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে শরীফ ইউ আহমেদের নকশা বাতিল করা হয়েছে। এই কাজগুলো করতে সময় লেগেছে।

“দ্বিতীয় ও তৃতীয় যে হয়েছে সেটা ঠিক আছে। এখন উনারা (ডিএনসিসি) সিদ্ধান্ত নেবেন, দ্বিতীয় যে হয়েছেন তার ডিজাইনটা নেবেন নাকি পুরো ফল বাতিল করে নতুন করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করবেন।”

অভিযোগের বিষয়ে শরীফ ইউ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে স্থপতি ইনস্টিটিউটের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তিনি বলনে, “আমি স্থপতি ইনস্টিটিউটের কাছে যা বলার বলেছি। আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।”

নকশা নিয়ে এ কেলেঙ্কারির বিষয়টি তিন দফা চিঠি পাঠানোর পর গত ১৯ জুন জানতে পারে ডিএনসিসি। ওই দিন মেয়রকে পাঠানো চিঠিতে আইএবি প্রথম বিজয়ীর পুরস্কার বাতিলের বিষয়টি অবহিত করে।

আইএবি জানায়, তদন্ত কমিটির সুপারিশে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া স্থপতি শাহ ফুয়াদ মোঃ সাইরাসের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের দলের তৈরি মডেলটিকে নতুন করে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

‘ঢাকা নর্থ সিভিক সেন্টার অ্যান্ড ডিএনসিসি টাওয়ার অ্যাট গুলশান’ শীর্ষক ওই প্রতিযোগিতায় স্থপতি মোহাম্মদ সাইফুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন ১৪ সদস্যের টিমের মডেলটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে।

এই নকশাটি দ্বিতীয় হয়েছে।

ডিএনসিসি জানিয়েছে, ফল প্রকাশের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এখনও ওই প্রতিযোগিতার বিস্তারিত তথ্য এবং নকশা বুঝিয়ে দেয়নি আইএবি। ফলে নতুন ভবন নির্মাণের কার্যক্রমও শুরু করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো ‘সিভিক সেন্টার’ নেই উল্লেখ করে প্রতিযোগিতার বিজয়ী ঘোষণার দিন ১৫ ডিসেম্বর মেয়র আতিক বলেছিলেন, ডিএনসিসির তৈরি কেন্দ্রটিই হবে প্রথম। রাজধানীর মানুষের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে এখানে। এটি হবে দৃষ্টিনন্দন ভবন।

“বড় ভবন করে দোকান বরাদ্দ দিলে ডিএনসিসির অনেক টাকা আসত। কিন্তু আমরা সে দিকে যাইনি। সিভিক সেন্টার করব, সেখানে ছোট থেকে বড় সব বয়সের নগরবাসী আসবেন, সারাদিন এখানে কাটাতে পারবেন। তাদের জন্য সব ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে এখানে।”

এ ভবন নকশা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে বলা হয়েছিল বিশ্বের নামীদামী স্থপতি দিয়ে এ ভবনের নকশা করতে। কিন্তু আমাদের দেশের স্থপতিরা বিভিন্ন দেশে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছেন। তাহলে কেন অন্য দেশের স্থপতি আনব।

“এ দেশের স্থপতিরাই এ ভবন বানাবেন। বিদেশিরা এসে দেখবেন, জানতে চাইবেন কে এই ভবন বানিয়েছেন।”

বিভিন্ন দেশে একটি সুনির্দিষ্ট বিশেষ ভবন বা কেন্দ্রে নাগরিকদের সভা, বিনোদন, খেলাধুলার ব্যবস্থা এবং সরকারি সেবা দেওয়ার ধারণা থেকে ‘সিভিক সেন্টার’ গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ভবন বা কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা বা সেবা পূরণ করা হয়।