ঢাকার মেট্রো রেল আর কতদূর

ঢাকার যানজট নিরসনের লক্ষ্য নিয়ে চলমান মেট্রো রেল প্রকল্পের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশটি আগামী ডিসেম্বরে উদ্বোধনের আগে স্টেশনগুলোতে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ।

জাফর আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2022, 06:21 PM
Updated : 21 July 2022, 04:23 AM

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এই অংশের নয়টি স্টেশনের শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য শৈলী আর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে সাজানো হচ্ছে যাত্রী ব্যবস্থাপনা।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে কাজের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৯৪ শতাংশ। রেল লাইন বসানোর কাজও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ট্রায়ালও দেওয়া হয়েছে।

ঢাকাবাসীর স্বপ্নের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এবং পরের বছর ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার মেট্রোরেল চালু করা যাবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। 

জানতে চাইলে ডিএমটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, “উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশনের সকল ফিটিংস স্থাপন শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

“ইতোমধ্যে সকল স্টেশনের সিঁড়ি, লিফট, এসকেলেটর, টিকেট কাউন্টার, ভেন্ডিং মেশিন, প্রতিবন্ধী যাত্রীর জন্য আলাদা কাউন্টারসহ এক্সিট-এন্ট্রিসহ সকল ধরনের যাত্রী ব্যবস্থাপনার আয়োজন শেষ করা হয়েছে।

“এখন বিশ্বমানের প্রযুক্তির সমন্বয়ে সাজানো হচ্ছে ষ্টেশনগুলো। শতভাগ কাজ শেষ করার পর্যায়ে রয়েছে।”

ফাইল ছবি

মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশনের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী দায়েম শাকের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ওই স্টেশনের প্রায় ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

“এখন বাকি আছে শুধু ক্যামেরা স্থাপন, ফেইস রিকগনিশন মেশিন আর টিকেট মেশিন স্থাপনের কাজ। এসব যন্ত্রপাতি সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। শুধুমাত্র বসানো বাকি আছে।”

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উত্তরা সেন্টার আইকন স্টেশনের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে এই স্টেশনটির নকশা পরিবর্তন করে সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজ বাড়ানো হয়েছে।

স্টেশনটির ‘কনকোর্স’ ছাদসহ পুরো স্টেশন জাতীয় পতাকার রং লাল-সবুজের সমন্বয়ে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে।

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনের মধ্যে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁও এই নয়টি স্টেশনের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে এখন।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত স্টেশনগুলোর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পের উপ ব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই অংশের নয়টি স্টেশনের কাজই শেষ পর্যায়ে।

তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ আগামী তিন মাসের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। এরপর আগামী ১৬ ডিসেম্বর রেল চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা সম্ভব হবে।

“বর্তমান যে নয়টি স্টেশনের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে তারমধ্যে উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে অবিস্থত উত্তরা উত্তর ষ্টেশনের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে।”

ফাইল ছবি

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিদ্দিক জানান, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ উদ্বোধনের পর যাত্রীর চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০ সেট ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এ পর্যন্ত জাপান থেকে ১৪ সেট ট্রেন ঢাকায় পৌঁছেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “একেকটি সেটে ছয়টি করে কোচ থাকবে। এই অংশের যাত্রীর চাহিদা বিবেচনা করে ট্রেন পরিচালনা করা হবে।”

তিনি বলেন, “উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রায়ালও দেওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের আগেই এই নয়টি ষ্টেশনের সকল কাজ শতভাগ শেষ হয়ে আমরা যাত্রী পরিবহণের জন্য শতভাগ প্রস্তুত হয়ে যাব।”

প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা

মেট্রেরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বা শারিরীকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য মেট্রোরেলে এবং মেট্রো স্টেশনে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা থাকবে।

যেমন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ও খর্বকায় ব্যক্তির জন্য টিকেট অফিস (টিওএম) মেশিন থেকে সহজে টিকেট সংগ্রহের জন্য অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার টিকেট বুথ থাকবে।

একইভাবে হুইল চেয়ার ব্যবহার করা যাত্রীরা যাতে টিকেট ভেন্ডিং (টিভিএম) মেশিন ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের টিকেট সংগ্রহ করতে পারেন সে ব্যবস্থাও থাকবে।

ফাইল ছবি

পেইড জোনে সহজে প্রবেশ এবং বাইরে যেতে হুইল চেয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় ভাড়া পরিশোধের প্রশস্ত গেইট থাকবে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে স্টেশনে উঠা-নামার জন্য লিফ্‌টের সামনে থাকবে র‌্যাম্প।

এছাড়া বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের লিফটে সহজে ওঠা-নামার সুবিধা দিতে লিফটের ভেতরে হাতল, নিম্ন উচ্চতায় কন্ট্রোল প্যানেল এবং নিজের অবস্থান বোঝার জন্য আয়না থাকবে।

অন্ধ যাত্রীদের জন্য লিফটের কন্ট্রোল প্যানেলে ব্রেইল পদ্ধতিতে নির্দেশনা দেওয়া থাকবে। মেট্রো স্টেশনে চলাচলের জন্য ব্লাইন্ড স্টিক ব্যবহারের সুবিধা দিতে হলুদ রংয়ের ‘ট্যাকটাইল’ পথের ব্যবস্থা রাখা হবে।

এমনকী মূক ও বধির যাত্রীরা ডিজিটাল নির্দেশনা অনুসরণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে মেট্রো স্টেশন ও রেলে চলাচল করতে পারবেন।

টয়লেট, লিফ্ট ও অগ্রাধিকার আসন সহজে বোঝার জন্য প্ল্যাটফর্ম ও মেট্রো ট্রেনে শনাক্তকারী চিহ্ন থাকবে। স্টেশন এলাকায় এবং মেট্রো ট্রেনের ভেতরে অডিও এবং ভিজুয়াল তথ্যের ব্যবস্থা থাকবে।

এই সিস্টেমের মাধ্যমে অন্যান্য যাত্রীদের মতো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যাত্রীরাও সেসব তথ্য শোনা এবং দেখার মাধ্যমে সহজে মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবেন।

মেট্রো কোচের বাইরের অংশ এবং প্ল্যাটফর্মের মধ্যে সবসময় এমনভাবে ফাঁকা রাখা হবে যাতে যাত্রীরা নিরাপদে ও সহজে মেট্রো ট্রেনে উঠা-নামা করতে পারেন।

নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোচ

মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য প্রতিটি ট্রেনের একটি করে কোচ শুধুমাত্র নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৯০ জন নারী যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।

নারী যাত্রীরা ইচ্ছা করলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারবেন। মেট্রো স্টেশনগুলোতে নারী যাত্রীদের জন্য আলাদা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা থাকছে। সেখানে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তনেরও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এছাড়া অন্তঃস্বত্ত্বা নারী এবং বয়স্ক যাত্রীদের জন্য কোচের ভেতরে আসন সংরক্ষিত থাকবে।

যাত্রী উঠানামায় নিরাপত্তা

ফাইল ছবি

মেট্রো রেলের নিয়ন্ত্রণ এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি সিস্টেম থাকবে। জরুরি পরিস্থিতিতে মেট্রো রেলের ভেতর থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্য জরুরি বহির্গমন দরজা রাখা হয়েছে।

মেট্রো স্টেশন, রুট অ্যালাইনমেন্ট এবং মেট্রো রেলে অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্নি নির্বাপনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

যাতায়াতের ভাড়া

সম্প্রতি মেট্রো রেলের ভাড়া নির্ধারণে গঠিত কমিটির প্রাথমিক প্রস্তাবে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৯০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন যাতায়াত করা যাবে। এক স্টেশন পর নেমে গেলেও ২০ টাকা দিতে হবে।

দেশের প্রথম উড়াল এই মেট্রো রেলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।

মোট ৬টি কোচ নিয়ে প্রতিটি একমুখী ট্রেন ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে থেমে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

সরকারের এক সমীক্ষায় বলা হয়, রেলটি চালু হওয়ার পর দৈনিক ভ্রমণ ব্যয় ও সময় বাবদ প্রায় ৮ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা এবং যানবাহন পরিচালন বাবদ প্রায় ১ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা সাশ্রয় হবে।

বিদ্যুৎ চালিত হওয়ায় মেট্রো রেলে জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানি ব্যবহার হবে না। ফলে বায়ু দূষণের কোনো সুযোগ নেই।

মেট্রো রেলে অল্প সময়ে বেশি সংখ্যায় যাত্রী যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হওয়ার ফলে ছোট যানবাহনের ব্যবহার অনেকাংশে কমে গিয়ে জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানির ব্যবহারও হ্রাস পাবে। এতে বায়ু দূষণ কমবে।

আরও খবর