এসএসসি: কতটা প্রস্তুত বানভাসিরা?

এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আচমকাই ঘরে এল বানের পানি, শত চেষ্টাতেও রক্ষা হল না বই-খাতা; মাথায় আকাশ যেন ভেঙে পড়ল সুনামগঞ্জের তারেকুল হাসানের।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2022, 07:28 PM
Updated : 16 July 2022, 07:28 PM

বসতভিটা ডুবে যাওয়ার সেই বিপদকালে ঘরের বেড়া আর টিনের চালও পানির তোড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ১২ দিন খাটের ওপর চৌকি তুলে কোনোমতে বেঁচে ফেরে জামালগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের পরিবারটি।

তবে ততদিনে বানের জল ভাসিয়ে নিয়েছে দরকারি নানা জিনিসপত্র; সঙ্গে গেছে বই-খাতা আর নোটও। প্রথম বড় পাবলিক পরীক্ষার আগে দুর্যোগের ঘনঘটায় অনিশ্চতার আঁধার ছেয়ে গেছে কিশোর ওই পরীক্ষার্থীর মনেও।

বিশ্বম্ভরপুর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী তারেকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “আমার বই-খাতা পানিতে ভেসে গেছে। নোটখাতা নষ্ট হয়ে গেছে। বইগুলা বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করছি। এগুলা তো আমার আগামী দিনের ভবিষ্যত। তারপরও পারি নাই।”

ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের রেকর্ড বৃষ্টি গত মাসে চরম দুর্ভোগ নিয়ে আসে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায়। মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিদ্যুৎ সরবরাহও।

তারেকুলের ছোট বোন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তার বই-খাতাও নষ্ট হয়েছে। বন্যায় কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কোনমতে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে এ কৃষি পরিবারকে। এর মধ্যে পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের জন্য।

দুরাবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী তারেকুল বললেন, “স্যার বলছে, বইয়ের ব্যবস্থা করে দিবে। বই পেলে পরীক্ষা দিতে পারব।

“কিন্তু নোটখাতায় সব নোট করে পড়ছিলাম। বই পেলেও সেইভাবে হয়ত পরীক্ষাটা দিতে পারব না। তবে সাধ্যমত ভালো দেওয়ার চেষ্টা করব।”

ফাইল ছবি

শুধু তারিকুল বা তার বোন নয়, বন্যায় বানভাসি অন্যান্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়েছে বেকায়দায়।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার বন্যায় পানি ওঠায় এবং আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় ১৮ জেলায় পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রাখতে হয়েছে। শুধু মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌনে ৬ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দুর্ভোগের এ বানের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ওপর। করোনাভাইরাসের কারণে চার মাস পিছিয়ে গত ১৯ জুন এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ১৭ জুন পরীক্ষা স্থগিত করা হলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ পরীক্ষার্থী।

এ পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি রোববার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন। সেখানে মধ্য অগাস্টের পর পরীক্ষার সূচি ঘোষণা হতে পারে বলে জানাচ্ছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।

অগাস্টে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব?

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, বানের পানি কমলেও ঈদ ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলায় ক্ষয়ক্ষতির বাস্তব চিত্র এখনও পরিষ্কার নয়। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো কতটা প্রস্তুত এবং কত সংখ্যক পরীক্ষার্থীর বই নষ্ট হয়েছে তা বোঝা যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর।

তবে তারা আশা করছেন, এক মাস সময় পেলে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যাবে। ১৯ জুলাই থেকে স্কুল খোলার আগের সূচি রয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুর রহমান সাজু জানালেন, প্রতিষ্ঠানটির ২৬৮ পরীক্ষার্থীর অনেকেরই বই পানিতে ভেসে গেছে।

“আমার এটা পরীক্ষা কেন্দ্র। পানিতে ভেসে বেঞ্চ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা সে অনুযায়ী সরকারকে চাহিদা দিব।

“১৯ জুলাই স্কুল খুললে কী পরিমাণ বই লাগবে, সে তালিকাও জানাতে পারব। বই পেলে পরীক্ষার্থীরা রিকভারি করতে পারবে। সবমিলিয়ে কেন্দ্র প্রস্তুত করতে এবং শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত হতে এক মাস সময় লেগে যাবে।”

মাটি ক্ষয় হয়ে মেঝে ভেঙে পড়ে স্কুলের টিন ও বেঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কবে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো যাবে তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না সুনামগঞ্জের শাল্লার সরলাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন দাস।

ফাইল ছবি

শিক্ষালয়টির ৩৯ পরীক্ষার্থী এক মাস ধরে পড়াশোনার বাইরে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়েছি, তারা কোনোমতে জান বাঁচাইছে; পড়বে কেমনে? যে যেখানে পারছে, আশ্রয় নিয়েছে।

“তাদের স্কুলমুখি করতে হবে। স্কুলে এনে যাদের বই নষ্ট হয়েছে, তাদের তালিকা দিয়ে বই আনার চেষ্টা করব। যাতে করে যতটুকু সম্ভব ভালভাবে পরীক্ষাটা দিতে পারে।”

মনোরঞ্জন বলেন, “পরীক্ষাটা অগাস্টের শেষ দিকে নিয়ে নিলেই ভালো হবে। এর বেশি পিছালে অন্যান্য পরীক্ষা নিতে অসুবিধা হবে।”

অগাস্টেই পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে মত দিলেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বাদাঘাট পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামও।

তার কথায়, “পরীক্ষা যত পিছাবে, বাচ্চারা পড়াশোনার দিক দিয়ে তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য মনস্ক হয়ে যাবে।

“যাদের হাতে বই নাই, তাদের বই দিয়ে ১৫-২০ দিন সময় দিলে ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারবে।”

বন্যার ধাক্কা কাটিয়ে ১৯ জুলাই ক্লাস শুরু করতে স্কুলে পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম শুরু করার কথা জানিয়েছেন তিনি।

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য ১০ হাজার বই পাঠাতে তালিকা দিয়েছেন জানিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, “কিছু বই নষ্ট হয়েছে। দুয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা থেকে তা আসবে।”

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের মিয়াধন মিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপন কুমার তালুকদার জানালেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত স্কুলটি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। পরিষ্কার করে শ্রেণিকক্ষগুলোকে এখন ক্লাসের উপযোগী করা হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির ১০২ জন শিক্ষার্থী এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে; আর এই কেন্দ্রে পরীক্ষার বেঞ্চে বসবে ৬৫৪ জন।

তপন কুমার বললেন, “শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সেজন্য অগাস্টের মাঝামাঝিতে পরীক্ষা নিলে তাদের ক্ষতি হবে না। আমরাও সেন্টারগুলো গুছাতে পারব।”

নেত্রকোণার শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল গফুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, এখন আর জেলার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না।

“অগাস্টে পরীক্ষা হলে মোটামুটি প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে। কারণ পানি তো কমে গেছে। হাতে ১৫-২০ দিন সময় আছে।”

এ জেলায় বই নষ্ট হয়েছে এমন তথ্য পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, “সেজন্য তালিকা পাঠাইনি, এমন হলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।”

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সহকারী বিতরণ নিয়ন্ত্রক ওবাইদুল হক জানিয়েছেন, দুর্গত জেলাগুলো থেকে সাড়ে ১১ হাজার বইয়ের চাহিদা পাওয়ার পর তা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

“এনসিটিবির গুদামে কিছু বই আছে। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লায় কিছু বই আছে। সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।”

ফাইল ছবি

সোমবারের মধ্যে এসব বই পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবিরি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান।

২০ জুলাই সিলেট, সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা বই হাতে পাবেন বলে জানিয়েছেন সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুন চন্দ্র পাল।

‘পরীক্ষা অগাস্টের মাঝামাঝিতে’

সুনামগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, জেলার কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও ত্রাণ শিবির আছে।

“১৯ জুলাই স্কুল খুলতে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। অগাস্টের মাঝামাঝিতে পরীক্ষা হবে, সে অনুযায়ী আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। সবাই মিলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, আশা করছি সব প্রস্তুত হয়ে যাবে।”

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুন চন্দ্র পাল মনে করেন, বন্যার পানি কমে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নেওয়া ও পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো প্রস্তুতে কিছু সময় প্রয়োজন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেক কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেসব কেন্দ্র তেমন ক্ষতি হয়নি, সেগুলোতেও পানি ঢুকছে।

“পরীক্ষার সূচি দেয়ার পরে অন্তত ১৫-২০ দিন প্রস্তুতির সময় দিতে হবে। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, ১৫ অগাস্টের আগে পরীক্ষার সম্ভাবনা খুবই কম। পরীক্ষা হবে এরপর। এটা হলে শিক্ষার্থী, পরীক্ষা কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গায়ই প্রস্তুতিটা স্বাভাবিক হবে।”

কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে জানালেও সুনির্দিষ্ট সংখ্যা তিনি জানাতে পারেননি।

আরও পড়ুন: