ঈদযাত্রার ভিড়ের চাপ এখনও পুরো মাত্রায় শুরু হয়নি। তবে ঢাকায় তাদের কাজ শেষ। তাদের কেউ যাবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে, রাজশাহীর দিকে; কারো বাড়ি বগুড়া বা নওগাঁয়।
এদেরই একজন শরিফুল ইসলাম যাবেন বগুড়ায়। আধা ঘণ্টা চেষ্টা করেও কোনো যানবাহনে উঠতে পারেননি তিনি।
শরিফুল বললেন, “বাসের লোকগুলাতো ছয়শর নিচে কথাই বলে না। ইঞ্জিন কভারেও ৪০০/ ৫০০ টাকা চায়। ট্রাকে যাবার চাছিলাম, ট্রাকআলারাও আড়াইশোর নিচে নামিচ্ছে না।”
নির্মাণ শ্রমিক শরিফুল এক ঠিকাদারের অধীনে পাইলিংয়ের কাজ করেন। রাজধানীর আফতাব নগরে কাজ চলছে। ঈদ ও গরু হাটের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় একটু আগেভাগেই বাড়ি যেতে পারছেন। কিন্তু তার কাছে ঈদ মানে কেবলই বাড়তি খরচের বোঝা।
এ কারণেই ২৮ বছরের শরিফুলকে বাড়ি যাওয়ার খরচের বিষয়েও অনেক সাবধানী হতে হয়। তার ভাষায়, “শুধু গেলে তো আর হবে না, আসার ভাড়াটাও লাগবে। কতগুলা টাকা বাড়তি খরচ চিন্তা করেন। মাঝে ১০ দিন কাজ বন্ধ।”
শরিফুলদের চারজনের দলটি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আফতাবনগর এলাকায় নিজেদের অস্থায়ী আবাস থেকে গাবতলীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তারা মাজার রোডে পৌঁছান। কিন্তু বিভিন্ন বাস কাউন্টার ঘুরেও সাধ্যের মধ্যে টিকিট মেলাতে পারেননি।
চাঁপাই নবাবগঞ্জগামী এসএম এন্টারপ্রাইজের একটি বাস রাত সোয়া ১১টার দিকে আমিনবাজার সেতুর ঢালে এসে দাঁড়ায়। যাত্রী তুলতে চালকের সহকারী ডাকাডাকি শুরু করেন। ইঞ্জিন কভারেও ৫০০ টাকা করে ভাড়া চাইছিলেন তিনি।
এত ভাড়ায় উঠতে রাজি না অপেক্ষমাণ যাত্রীরা। আবার হেলপারও কমাতে রাজি না। এদিকে পেছন থেকে ক্রমাগত সবুজ লেজার লাইট মেরে যাচ্ছে পুলিশ, ইংগিত দিচ্ছে দাঁড়িয়ে না থেকে গাড়ি ছাড়ার।
বাসের চালক বা হেলপারের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। পেছনে গাড়ির লাইন পড়ে যাওয়ায় তেড়ে এলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল, বুকের নেইমপ্লেটে লেখা ‘সালেক’।
তবে দরদামে খুব বেশি সুবিধা হল না, ৩০০ টাকা করে দুজন যাত্রী হাটিকুমরুল মোড় পর্যন্ত যেতে বাসে উঠলেন।
আমিনবাজার সেতুর ঢাকা প্রান্তে ট্রাকগুলোকে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না পুলিশ। আর বাসের ভাড়া এই যাত্রীদের নাগালের বাইরে। শরিফুলদের দলটি বাসে কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে ট্রাকের আশায় ফুটপাতে রাখা গাট্টি -বোঁচকা কাঁধে তুলে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল।
হেঁটে আমিনবাজার সেতু পার হয়ে ওপারে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখা গেল, সেখানে আগে থেকে ভিড় জমিয়েছেন আরো অন্তত জনা চল্লিশেক মানুষ। সবাই উত্তরবঙ্গের যাত্রী। নিম্ন আয়ের এ মানুষগুলো যেভাবেই হোক, কম খরচে বাড়ি ফিরতে চান।
দূর থেকে একটা ট্রাককে বাঁয়ের ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে ধীর গতিতে আসতে দেখে নড়েচড়ে উঠলো জটলা। খালি ক্রেট বোঝাই ট্রাকটি যাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। হেল্পার ডাক ছাড়লেন- “নাটোর, রাসসাই, চাপাই।”
নিচের জটলা থেকে কেউ একজন জানতে চাইলেন, “কত?”
উপর থেকে চার আঙ্গুল দেখিয়ে হেল্পার জানিয়ে দিলেন- চারশ টাকা। জবাবে নিচ থেকে দুই আঙ্গুল দেখানো হল। এবার উপর থেকে তিন আঙ্গুল দেখিয়ে হেল্পার বললেন, “একদাম, গেলে উঠেন।”
হেলপারের জবাব, “সব জিনিসের দাম বাড়াইছে সরকার, আমরা চাইলেই দোষ। দুইটা লোক নিলে পরে মামাগোরেও দিতে হয়। দিয়া থুয়্যা আমার তো দুইটা পয়সা থাকা লাগব।”
হেলপারের কথায় কাজ হল না, কেউ ওই ট্রাকে উঠল না। তবে জটলায় এবার যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা গড়ালো সরকারের সমালোচনায়। “গরিবের জন্য কিচ্ছু করে না, কেউ কিচ্ছু ভাবে না” ইত্যাদি ছেঁড়া ছেঁড়া অনুযোগ ভাসতে থাকল আলাপে।
পান-সিগারেট, বুট-বাদামওয়ালারা আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। বিক্রিও খারাপ না। নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে একসঙ্গে হওয়া ঘরমুখো মানুষের দল। ফোন নম্বর বিনিময়ও হচ্ছে। কোন ঠিকাদারের কাছে গেলে অসময়েও কাজ পাওয়া যায়, সেই আলাপও হচ্ছে।
এর মধ্যেই আরো বেশ কয়েকটি ট্রাক এল, প্রতিবারই জটলার কিছু লোক ছুটে গিয়ে দরদাম করলেন। রাজশাহী বা বগুড়া- কোনো গন্তব্যের ভাড়া ৩০০ টাকার নিচে নামালেন না হেলপাররা। যাত্রী উঠল কমই।
তাদের মধ্যে একটু বয়স্ক জবেদুল বললেন, “এখনো অনেক লোক তো, ভিড় একটু কমুক, রাত একটু বাড়ুক- ভাড়া এমনিতেই কমবে। অযথা ছোটাছুটি করে লাভ নেই।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই জবেদুলের কথা সত্যি হল। প্লেইনশিট বোঝাই একটি মিনি ট্রাক এসে দাঁড়ালে হেলপার প্রথমে বগুড়ার ভাড়া ৩০০ টাকাই চাইলেন। জটলার লোকেরা ঘিরে ধরে দরদাম শুরু করলেন।
ট্রাক চালক এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওই, কয় পিস আছে?” জটলা থেকে একজন মাথা গুণে জানালেন, বগুড়ার যাত্রী ৯ জন। চালক এবার বললেন, “আমারে সবটি মিল্লা দেড় হাজার দিবা।”
শেষ পর্যন্ত নয়জনে মোট ১২০০ টাকার রফা হল। এর মধ্যেই আমিনবাজারের ওইপাশ থেকে লেজার মারতে শুরু করেছেন পুলিশের একজন সদস্য। পুলিশের তৎপরতা দেখে ট্রাকচালক এক্সিলেটরে হালকা চাপে ধীর গতিতে এগিয়ে নিতে থাকলেন গাড়ি, যাতে যাত্রীরা সবাই উঠতে পারেন।
পেছন থেকে শুরু হল হুড়মুড় করে ট্রাকে ওঠা। ‘ওই আমার বস্তাটা ধর’, ‘বালতিটা ফিক্যা মারো’- এরকম নানা কথায় হইচই করতে করতে নয় জনের দলটি ট্রাকে বসে পড়লেন।
রাত ১টার পর বগুড়ার পথে জনপ্রতি একশ থেকে দেড়শ টাকা ভাড়ায় ট্রাক পাওয়া যেতে লাগল। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ তখনো ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কাঙ্খিত দরে ট্রাক না পেয়ে দলটি আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। ঢাকার বিভিন্ন হাটে গরু রেখে ট্রাকগুলো তখন ফিরতি পথে রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল।
গরুর গোবর ও আবর্জনা থাকায় অনেকেই সেসব ট্রাকে উঠতে চাইছিলেন না। এর মধ্যে একটি ট্রাক এসে দেড়শ টাকা ভাড়া হাঁকতে শুরু করলে আবর্জনার কথা মাথায় না নিয়ে তাতে উঠে পড়ে বড়সড় একটা দল। আমিনবাজার তখন মোটামুটি খালি।
তবে সেতুর উপর দিয়ে একজন দুজন করে হেঁটে আসতে দেখা গেল। আবার জমতে লাগল জটলা। ট্রাকের হেলপাররা জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভাড়া হাঁকতে থাকলেন। চললো দরদাম।
জটলার মধ্যে পান সিগারেট বিক্রেতা সোহেল জানালেন, এরকম চলবে ভোর পর্যন্ত। সকালের পর ট্রাক চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের জটলাও থাকবে না।