হিলালীকে তুলে নিয়ে যা করেছিল অপহরণকারীরা

ব্যবসায়ী আমিন মো. হিলালীকে যারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারা তার কাছ থেকে ‘ঘুষ দেওয়ার স্বীকারোক্তি’ নিয়ে রাখে বলে জানিয়েছেন তার ভাই।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2022, 05:57 PM
Updated : 5 July 2022, 02:09 AM

নিখোঁজ ভাইকে তিন দিন বাদে ফিরে পাওয়ার পর সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একথা জানিয়েছেন রফিকুল ইসলাম হিলালী।

তবে কারা তাকে ধরে নিয়ে এই ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় করেছে, সে বিষয়ে তার ভাই কিছু বলতে পারেননি বলে জানান তিনি।

আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন হিলালী গত শুক্রবার ঢাকার উত্তরার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন।

তাকে খুঁজে না পেয়ে পরদিন থানায় জিডি করে পরিবার। রোববার সংবাদ সম্মেলনও করে। এরপর রাতেই তাকে ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় পাওয়া যায়।

ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছেন, তার ভিত্তিতে রফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া আর কোনো প্রশ্ন অপহরণকারীরা তার ভাইকে করেনি।

তিনি বলেন, “অপহরণের পর গোপন স্থানে নিয়ে ঘুষ দেওয়ানোর কথা স্বীকার করানো হয়েছিল তার কাছ থেকে। এই ‘স্বীকারোক্তি’ ভিডিওতে ধারণ করানোর আগে ‘রিহার্সাল’ দেওয়া হয়। রেকর্ড করার আগে কী বলতে হবে, সেটা তারা বলে দিত। তারা বলত- ‘হাসি মুখে বলেন’, ‘মন খারাপ করে বলবেন না’।”

তবে তার উপর শারীরিক কোনো নির্যাতন না চালালেও হাতের ১০ আঙ্গুলের ছাপ এবং স্বাক্ষর অপহরণকারীরা নিয়ে রেখেছে বলে জানান রফিকুল

আমিন হিলালী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জমি কেনার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলার আসামি। ওই মামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি এম এ কাশেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান এখন কারাগারে রয়েছেন।

আমিন হিলালী কোনো দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করে আসছেন তার ভাই রফিকুল। তিনি বলছেন, আশালয় হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তার ভাই শুধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে জমির দলিল করে দিয়েছিলেন।

এই অবস্থায় কারা তাকে তুলে নিয়ে ‘স্বীকারোক্তি’ নিল, সে বিষয়ে জানার আগ্রহ রফিকুল চাপা দিচ্ছেন ভাইকে পেয়ে।

তিনি বলেন, “কারা এটা করেছে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া আমরা তাকে ফিরে পেয়েছি, তাই এনিয়ে আমাদের পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই।”

হিলালীর সন্ধান জানার পর রোববার রাতেই তাকে উত্তরার বাড়িতে নিয়ে যায় পরিবার।

রফিকুল জানান, তার ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তার হৃদরোগ আছে। সোমবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।

হিলালীর পরিবার জিডি করেছিলেন উত্তরা পশ্চিম থানায়।

উদ্ধারের পর হিলালীর অন্তর্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়াসিন গাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনাদের কাছ থেকে জানার পর আমরা তাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। তিনি পরিবারের হেফাজতে আছেন। আমরা জেনেছি, তিনি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি আছেন। উনি সুস্থ হওয়ার পর আমরা উনার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব।”

যেভাবে নিখোঁজ, যেভাবে মুক্ত

গত শুক্রবার বাসা থেকে বের হওয়ার পর একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে আমিন হিলালী তার স্বজনদের জানিয়েছেন।

রফিকুল বলেন, “ঘটনার দিন তাকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার পর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর তাকে একটি ঘরে নেওয়া হয়। তিনি বলেছেন, সেই ঘরটি গারদের মতো।”

এই স্থানটি কোথায়, তা বুঝতে পারেননি আমিন হিলালী। তবে যে পথ দিয়ে তাকে নেওয়া হয়েছিল, সেই রাস্তাটি খুবই খারাপ ছিল বলে তার মনে হয়েছে।

চোখ খুলে দেওয়ার পর নিজেকে আনুমানিক ৩৬ বর্গফুটের (৬ ফুট*৬ ফুট) একটি কক্ষে নিজেকে দেখেন হিলালী। কক্ষটিকে কোনো জানালা ছিল না। লোহার গ্রিলের দরজা ছিল,তার মধ্যে পকেট গেইটও ছিল। সেই পকেট গেইট দিয়ে তাকে ঢোকানো এবং বের করা হত।

রফিকুল বলেন, “কক্ষটির দরজা বরাবর বাইরে একটি সিসি ক্যামেরা ছিল। কখনও টয়লেটের প্রয়োজন দেখা দিলে সিসি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাত উঠানোর জন্য তাকে (হিলালী) বলে রাখা হয়েছিল। হাত উঠানো দেখলে একজন এসে তাকে চোখ বেঁধে বাথরুমে নিয়ে যেত।”

কক্ষটিতে কোনো বাতি কিংবা সুইচ দেখতে পাননি হিলালী। তবে কক্ষের বাইরের বাতির যথেষ্ট আলো ভেতরে আসত। আর লোহার দরজার বাইরে একটি ফ্যান ছিল এবং তা সারাক্ষণ চলত।

রফিকুল বলেন, তার ভাইকে দেখভালের জন্য একজন চিকিৎসকও ছিল সেখানে। কী ওষুধ খেতে হবে, কখন খেতে হবে, ওজন, প্রেসার সব কিছুই নিয়মিত দেখা হত।

শুক্রবার সেখানে নেওয়ার পর দুদিন রেখে রোববার রাতে চোখ বেঁধে বের করা হয় বলে হিলালী জানিয়েছেন।

রফিকুল বলেন, ওই কক্ষ থেকে নিচে নামিয়ে গাড়িতে উঠানোর পর প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরিয়ে তার ভাইকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

“তাকে নামানোর পর সোজা হেঁটে যেতে বলা হয়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর কারও কোনো সাড়া না পেয়ে চোখ খুলে তিনি দেখেন যে জঙ্গলের মধ্যে রয়েছেন। পরে সেখান থেকে কিছুদুর হেঁটে রাস্তায় উঠে জানতে পারেন, এটা হেমায়েতপুর তেঁতুলঝোড়া।”

এরপর একজন অটোরিকশাচালককে পেয়ে তার মোবাইল ফোন থেকে বাড়িতে কল করেন হিলালী। তখন বাড়ির সদস্যরা গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন।