বন্যায় বসতঘর পরিণত বীজতলায়, বছরের খোরাকি হাঁসের আধার

থকথকে কাদার মধ্যে ঘন হয়ে গজিয়েছে সবুজ ধানের চারা; প্রথম দেখায় মনে হতে পারে কৃষকের বীজতলা।

মাসুম বিল্লাহ সুনামগঞ্জ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2022, 07:19 PM
Updated : 4 July 2022, 07:19 PM

কিন্তু মাথার ওপর টিনের ছাউনি, চার পাশের বেড়া, চৌকানা ধানের গোলা, খাট আর কক্ষ ভাগ করার চিহ্ন বলে দিচ্ছে, এটা ছিল কোনো এক কৃষকের বাড়ি।

বন্যায় তছনছ হওয়ার আগে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার জালালপুর পয়েন্টের এই জায়গায় ছিল কৃষক সিরাজুল ইসলামের দুঃখ-সুখের সংসার।

ধানের ওই গোলার তলা ভেঙে প্রায় ২০ মণ ধান ভেসে গেছে তাদের। যেগুলো বেড়ার কারণে ভিটায় আটকে ছিল, সেগুলোতে চারা গজিয়েছে।

ছেলে কর্মক্ষম হয়ে ওঠায় কৃষিকাজে ভালোই চলছিল সিরাজুলদের হাওরের জীবন; আসছে বছরের খোরাকির জন্য গত বৈশাখে গোলায় রেখেছিলেন ওই ধান।

বন্যার ১৫ দিন পর গত শুক্রবার সিরাজুলের পরিবারকে পাওয়া গেল সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়কে বাঁশ আর প্লাস্টিকের ছাউনির অস্থায়ী ঘরে। সড়কের পাশেই সিরাজুলের ঘর, বন্যার পর যা বীজতলার রূপ নিয়েছে।

দোয়ারাবাজারের মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আমবাড়ি এলাকার বন্যায় ভিজে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ধান দেখাচ্ছে এক নারী ।

পুরো বছরের খোরাকির দুশ্চিন্তাকে নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে ৬৫ বছর বয়সী সিরাজুল অনেকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, “বন্যায় সব নিয়ে গেছে, এখন কী আর করার। কিনে খেতে হবে আর কি।”

সুনামগঞ্জে স্মরণকালের বড় বন্যায় সিরাজুলদের মত বহু পরিবারের গোলার ধান ভেসে গেছে; অনেকের ধান ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে না গেলেও হয়ে গেছে নষ্ট।

গত তিন দিন সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার উপরে ধান শুকাচ্ছেন কৃষক-কিষাণিরা। সেই সোনালী ধান ভিজে কালো কালো ছোপ, অনেকের ধানে হয়েছে অঙ্কুরোদ্গম।

স্থানীয়রা জানালেন, এবার এ নিয়ে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছে সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল। এপ্রিলের শুরুতে ধান পাকা শুরু হতেই বাঁধ ভেঙে নষ্ট হয়েছে ধান, জমিতে পানি জমায় পোক্ত হওয়ার আগেই তারা ধান কেটেছেন। এরপর মে মাসের শেষের দিকে ধান কাটার মধ্যে উজান থেকে ফের ঢল নামল।

সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোমের তথ্য বলছে, এপ্রিল ও মে মাসে পানির জমার কারণে মোট ৬ হাজার ৬৫৮ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

সব মিলিয়ে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে ৮ লাখ ৭২ হাজার ১৪৯ টন বোরো চাল উৎপাদন হয়েছে বলে জানান তিনি।

গতবার সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ দুই হাজার টন বোরো চাল উৎপাদন হয়েছিল। এই হিসাবে এবার উৎপাদন ২৯ হাজার ৮৫১ টন বা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ কম হয়েছে।

জুনের বন্যায় ১২ হাজার ৮১৩ হেক্টরের মধ্যে ৬ হাজার ১২৫ হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা বিমল।

তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের স্থানীয় মানুষের ৬ লাখ ১১ হাজার টন চালের চাহিদা রয়েছে।

সিরাজুলদের মত বসতঘর বীজতলায় পরিণত না হলেও গোলার ৪০ মণের অর্ধেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে সদর উপজেলার জানিগাঁও এলাকার আইনুল হকের।

২০ মণ নষ্ট ধানের বেশিরভাগের অঙ্কুরোদ্গম হয়ে গেছে। সেগুলো খাওয়ার উপযোগী করা যাবে কি-না, এখনও জানেন না তারা।

পেশায় মাইক্রোবাস চালক হলেও পারিবারিকভাবে বর্গাচাষে জড়িত আইনুল। ৪০ মণ ধান দিয়ে ১০ সদস্যের পরিবারের খোরাকি চলার কথা ছিল তাদের।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ আতপ চালের ভাত খান। কৃষক পরিবার বছরের খোরাকি ঘরের গোলায় রাখার চেষ্টা করে। দুয়েক মাস পরপর প্রয়োজন অনুযায়ী চাল ভাঙিয়ে নেন তারা।

আইনুলদেরও বছরের বড় সময়ের খোরাকি হওয়ার কথা ছিল ৪০ মণ ধানে, এখন ভাতের কষ্টে পড়ার আশঙ্কা তার মনে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আইনুল বলেন, “বইন্যাতো সব ভাসায় নিছে গি। কি আর করা, কিইন্যা খাইত ওইব।”

’মানুষের খাবারে হাঁসের আধার’

বন্যা যেদিন শুরু হয়, ঘরের ৪০ মণ ধান বাঁচানোর চিন্তা করার সুযোগ হয়নি বিশ্বম্ভপুর উপজেলার দক্ষিণ ইসলামপুরের খদিজা বেগমের। জীবন রক্ষার তাগিদে কিছুটা দূরের একটি পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি।

ঘরের গোলা আর বস্তায় বস্তায় স্তূপ করা ছিল খদিজাদের পুরো বছরের খোরাকি। বন্যার পানি নামার পর এসে দেখছেন, সোনালি ধান হয়েছে কালো, বের হচ্ছে পচা দুর্গন্ধ।

ওই চাল আর খাওয়া যাবে না বলে সেগুলো শুকানোর ঝামেলায় যাননি খদিজারা। সেসব পচা ধান বিক্রি করে দিয়েছেন হাঁসের খামারে।

তার মেয়েজামাই মাসুক মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এমনিতে ধানের দর ৯০০-৯৫০ টাকা মণ হলেও খামারির কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে পেয়েছেন তারা। অন্য কোনো উপায়ও ছিল না।

”ধানের যে অবস্থা হয়েছে, কোনোভাবে খাওয়া যাবে না। সে কারণে হাঁসের খামারে বিক্রি করে দিয়েছি। হাঁসতো সবই খায়।”

২০-২২ বিঘা জমির ১৫০ মণ ধান ঘরে জড়ো করে রেখেছিলেন দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের মুনফর আলী, ৬ জনের সংসারে বছরের খোরাকির পাশাপাশি ধান বিক্রি করে প্রাত্যহিক খরচ মেটাতেন তিনি।

গোলা আর বস্তাসহ তার ৪০ মণের মত ধান ভেসে গেছে বানের জলে। যেটুকু রয়েছে, তাও কালো হয়ে গেছে, বের হচ্ছে দুর্গন্ধ।

বানের পানির নেমে যাওয়ার পর বাড়ির সামনের সড়কে সেগুলো তুলে শুকিয়েছেন মুনফররা। কিন্তু ওই ধান আর খাওয়ার উপযোগী নেই বলে তিনি জানালেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মুনফর বলেন, “শুকিয়ে রাখছি। কিন্তু এগুলোতো খাওয়া যাবে না, হাঁসের খামারে বিক্রি করব হয়ত।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি শামস শামীম]