পরীক্ষার কী হবে, স্কুল খুলবে কবে, উত্তর পাচ্ছে না হাওরের শিক্ষার্থীরা

বানের জল হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লে বাড়ির অন্যরা যখন জিনিসপত্র সামলাতে ব্যস্ত, দুই বোন রাবেয়া আক্তার ও তাসলিমা আক্তারের সংগ্রাম তখন বইখাতা নিয়ে।

মাসুম বিল্লাহ সুনামগঞ্জ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2022, 07:16 PM
Updated : 4 July 2022, 03:21 AM

পড়ুয়া পাঁচ ভাইবোনের কিছু বইখাতা পানির স্রোতের মধ্যেও মাচায় উপর তুলে রক্ষা করতে পেরেছিল ওরা; বাকিগুলো পাঁচদিন ধরে পচেছে বানের পানির নিচে।

ভাইবোনদের মধ্যে রাবেয়ার দুশ্চিন্তাই বেশি; যখন বন্যা শুরু হয়, তার তিন দিন বাদে ১৯ জুন থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল তার।

রাবেয়া সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভপুর উপজেলার শক্তিয়ার খলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী; ছোট বোন তাসলিমা একই স্কুলে নবম শ্রেণিতে।

১৮ দিন পর শনিবার রাবেয়ারা স্কুলে গিয়েছিল খোঁজ নিতে, কবে নাগাদ পরীক্ষা শুরু হবে, আর কবেই বা বাজবে স্কুলের ঘন্টা।

কিন্তু স্কুলে গিয়ে মানবিক বিভাগের ছাত্রী রাবেয়া দেখল, তার সহপাঠীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড রোদে শুকাচ্ছেন শিক্ষকরা; যেগুলো ভিজে জবজবা হয়েছে বন্যার পানিতে। ক্লাস-পরীক্ষা শুরু কবে হবে, তার উত্তর শিক্ষকদের কাছেও নেই।

“তারাও (শিক্ষকরা) জানেন  না, কোন দিন কী হবে। বইয়ের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতেছে, কিন্তু শিওর না,” বললো রাবেয়া।

রাবেয়া সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভপুর উপজেলার শক্তিয়ার খলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রাবেয়া আক্তার এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শক্তিয়ার খলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর ১৬৫ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা বলে জানাল এই কিশোরী।  

বিশ্বম্ভপুর উপজেলার হাওরবেষ্টিত গ্রাম মধুপুর থেকে স্কুলে যেতে বর্ষাকালে তাদের প্রথমে ৫-৭ মিনিট ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বিশ্বম্ভপুর-তাহিরপুর সড়কে ‍উঠতে হয়। এরপর সেখান থেকে আধা ঘণ্টার মত পায়ে হাঁটতে হয়।

শনিবার যখন কথা হল, স্কুল থেকে নৌকা চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল রাবেয়া-তাসলিমারা। চাচাতো বোন মারজানা বেগমকে নিয়ে বৈঠা চালাচ্ছিল তাসলিমা।

রাবেয়া ও তাসলিমা জানাল, তাদের স্কুল ঘরেও পানি ছিল কোমর পর্যন্ত। এখনও স্কুল মাঠে পানি থৈ থৈ করছে।

শক্তিয়াল খলা উচ্চ বিদ্যালয়ের মত জেলার বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানালেন জেলা শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর আলম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বেশিরভাগ জায়গায় বইখাতা, কাগজপত্র, চেয়ার-টেবিল ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞান ল্যাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্কুল এখন বন্ধ। আবার কোথাও কোথাও স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিয়ে আছে বন্যাদুর্গত মানুষ।

জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ”ক্ষতি তো অনেক। এখনো ক্ষতির হিসাব পুরোপুরি করতে পারিনি আমরা। ঈদের পরে ভালোমত খতিয়ে দেখব, তখন হয়ত স্কুল-কলেজ খুলে দেব।”

জেলা শিক্ষা অফিসের অধীনে সুনামগঞ্জ মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৩৩টি স্কুল, ৩৩টি কলেজ এবং ৯১টি বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে বলে জানান জাহাঙ্গীর।

জেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুর রহমানও বললেন, ১ হাজার ৪৭৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো তারা নিরূপণ করতে পারেননি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

”কোথাও কোথাও বন্যার পানি এখনো নামেনি। প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো কিছু প্রতিষ্ঠান পানিতে নিমজ্জিত। কোনো কোনো এলাকায় মানুষ শেল্টারগুলো ছেড়ে যায়নি,” বললেন তিনি।

এ দৃশ্য সুমানগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাদাঘাট দক্ষিণ ইউনিয়নের ওমপুর গ্রামের। মোটরসাইকেলের সামনে এক শিশুকে বসিয়ে বন্যায় ডোবা সড়ক পাড়ি দিচ্ছে একটি পরিবার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

২৬ জুন থেকে বিদ্যালয়গুলো ২১ দিনের ঈদের ছুটিতে যাওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ১৬ জুন থেকেই বন্ধ রয়েছে বলে রহমান জানালেন।

তিনি বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে কিছু বই মজুদ থাকে। যে শিক্ষার্থীদের বই নষ্ট হয়েছে, ছুটির পরে তাদের সেখান থেকে বই দেওয়ার চেষ্টা করবেন তারা।

এই বন্যা আসার আগে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণেও দুই বছর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেছিল, সে কথাও মনে বাজছে বিশ্বম্ভপুরের তাসলিমার।

কথায় কথায় সে বলল, “দুই বছর করোনায় বন্ধ ছিল, এখন আবার বন্ধ। স্যাররাও বলতে পারছে না, কবে আমাদের জন্য কী করবে।”

বন্যার কারণে অর্ধবার্ষিকে দুটি বিষয়ের পরীক্ষায় বসতে পারেনি তাহিরপুর উপজেলার হাওরবেষ্টিত উত্তর শ্রীপুর এলাকার তাকবীর হোসেন। লামাগাঁওয়ের মোয়াজ্জমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়ে সে।

তার বাড়ি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় টাংগুয়ার হাওর পেরিয়ে স্কুলে যেতে প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে যায়। সে কারণে বেশিরভাগ সময় স্কুল এলাকায় খালার বাড়িতেই থাকে তাকবীর।

সে জানাল, অর্ধবার্ষিকের ১৬ জুনের পরীক্ষা দিয়ে নিজের বাড়িতে এসে বন্যায় আটকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্কুল কিছুটা উঁচুতে থাকায় তখনও পানি ওঠেনি। তাতে ১৭ ও ১৮ তারিখের পরীক্ষা নিতে পেরেছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু তাকবীর যেতে পারেনি।

এর মধ্যে ঘর থেকে জিনিসপত্র হাওরে ভেসে যেতে দেখেছে সে। সেগুলো রক্ষায় লড়াই করেছে বানের পানির সাথে।

সেই সংগ্রামের কথা মাথায় রেখেই হয়ত তাকবীর বলছিল, “বন্যায় আমাদের প্রায় সব শেষ, জীবনটা আছে। আমাদেরকে এ নিয়ে বাঁচতে হবে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি শামস শামীম]