হলি আর্টিজানের সেই রাত যেভাবে বদলে দেয় বাংলাদেশকে

ছয় বছর আগের ভয়ঙ্কর সেই রাত বদলে দেয় বহু মানুষের জীবন, সেই রাতের বিভীষিকা নাড়িয়ে দিয়ে যায় ‍পুরো বাংলাদেশকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2022, 05:26 AM
Updated : 1 July 2022, 07:37 AM

গুলশান-২ নম্বর এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে সন্ধ্যায় সেখানে জঙ্গি হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার।

পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা। গোলাগুলির খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান গুলশান থানা পুলিশের সদস্যরা। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলির খবর মুহূর্তে পুলিশের ওয়্যারলেসে ছড়িয়ে পড়ে।

জবাই করে এবং গুলি চালিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে উগ্রবাদী সেই তরুণের দল। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

হলি আর্টিজান বেকারিতে অস্ত্রধারীদের হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে গেলে হামলাকারীরা গুলি চালানোর পাশাপাশি গ্রেনেড ছোড়ে। তাতে আহত হন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। তিনিও মারা যান হাসপাতালে।

ভয়ঙ্কর সেই রাতের শেষে কমান্ডো অভিযানে জঙ্গিদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হলি আর্টিজান সংকটের অবসান হয়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন ওই জঙ্গি হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।

ছয় বছর পেরিয়ে এসে পুলিশের দায়িত্বশীলরা বলছেন, সেই বদলটা হয়েছে ‘ইতিবাচক’, সে কারণে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকেও এখন বাংলাদেশের অবস্থান ‘অনেক ভালো’।

হলি আর্টিজানের ওই হামলা সাধারণ মানুষের মত চমকে দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও। সন্ত্রাস, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতির মত ঘটনা মোকাবেলা করে অভ্যস্ত পুলিশ-র‌্যাবকে জঙ্গিদের সরাসরি মোকাবেলার বড় পরীক্ষায় নামতে হয়।

ওই ঘটনার মাত্র চার মাস আগে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ দমনে গঠন করা হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তারাও ওই হামলা সম্পর্কে প্রথমে বুঝতেই পারেনি।

সেই রাতের অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তার চিত্রকেও। এখন যে কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আগেই নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এলাকা ঘিরে নিরাপত্তা মহড়া দেয়। বোমা অপসারণ ইউনিটের সদস্যরা খুঁজে পেতে দেখেন ঝুঁকিপূর্ণ কিছু রয়েছে কি না। নিরাপত্তার জন্য র‌্যাব, সিটিটিসিসহ পুলিশের একাধিক ইউনিট প্রশিক্ষিত কুকুর এনে ‘ক্যানাইন’ গঠন করেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আগে এখন সেসব কুকুরকেও মাঠে দেখা যায়।

গ্রেপ্তার পৌনে তিন হাজার

হলি আর্টিজান হামলার পর প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় নেয়নি। সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের নেতৃত্বে অপারেশন ‘থান্ডারবোল্ট’ এর মধ্য দিয়ে হলি আর্টিজানের জিম্মিদের মুক্ত করা হয়। সেই অভিযানেই নিহত হয় হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণ।

এর ২৫ দিন পরেই রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজ বাড়ি বলে পরিচিত একটি ভবনে গড়ে তোলা জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় সিটিটিসি। সেখানে নয়জন জঙ্গি নিহত হয়। 

এরপর একে একে পরিচালিত হয় নারায়ণগঞ্জে অপারেশন হিট স্টর্ম-২৭, গাজীপুরের পাতারটেকে অপারেশন স্পেড-৮, সিলেটে অপারেশন টোয়াইলাইটসহ অনেকগুলো অভিযান।

সিটিটিসি জানাচ্ছে, হলি আর্টিজানের ঘটার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান’ পরিচালনা করেছে তারা। এসব অভিযানে নিহত হয়েছেন ৬৩ জন। এর মধ্যে হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীও রয়েছেন।

গত ছয় বছরে সিটিটিসি মোট ৫৫৯ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া অনলাইনে উগ্রবাদ ছড়ানোর অভিযোগে আরও ৪৭২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এ ইউনিটটি।

র‌্যাব জানাচ্ছে, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর তাদের পরিচালিত ৭৭৯টি উগ্রবাদবিরোধী অভিযানে ১ হাজার ৬৭৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এ সময়ে তারা ৫৪টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছেন। র‌্যাবের অভিযানেও হলি আর্টিজানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী সারোয়ার জাহানসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়।

‘ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন’

সেদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে পরে জঙ্গি দমনে বিশেষ সেল গঠন করার পাশপাশি ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর সারা দেশের জন্য পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট নামে পৃথক একটি ইউনিট গঠন করা হয়। র‌্যাবেও রয়েছে জঙ্গি নিয়ে কাজ করার পৃথক সেল।

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে এর মধ্যে বিদেশে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন শতাধিক কর্মকর্তা। এসেছে নতুন অস্ত্র, সরঞ্জাম ও গাড়ি। পেতে রাখা বোমা অপসারণে ঢাকার সিটিটিসি এখন জার্মানি থেকে আনা দুটি অত্যাধুনিক রোবটের সাহায্য নিচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর আভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদবিরোধী প্রচার বন্ধেও গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। সেজন্য বিশেষ প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসির প্রধান (অতিরিক্ত কমিশনার) আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের ‘সন্ত্রাস দমন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪৮টি জেলায়েএ ধরনের কর্মসূচি হয়েছে।

“একটা ছেলে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হলে কী ধরনের লক্ষণ দেখা যাবে, এটা যদি কেউ না জানেন, তবে তিনি নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে পারবেন না। এ বিষয়গুলোই আমরা প্রচার করেছি।”

আসাদুজ্জামান দাবি করে, তাদের এই প্রচারের কারণে তরুণ প্রজন্মকে আগের মত অনলাইনে আর ‘উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না’ উগ্রবাদীরা।

হামলাকারী পাঁচ তরুণ- নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।

“আমাদের তরুণ প্রজন্ম তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে শিখে গেছে। তারা উগ্রবাদীদের সেইসব আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না। এখন জঙ্গিদের অনলাইন র‌্যাডিক্যালাইজেশন কার্যক্রমও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।”

আর এরমধ্যেই যারা উগ্রবাদের দীক্ষা নিয়েছেন, তাদের জন্য ‘ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন’ কর্মসূচিও শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানান সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, “পুলিশের ‘সন্ত্রাস দমন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের ডি র‌্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। সেজন্য প্রথমত দরকার সাইকোলজিস্ট, তারপরে ইসলামের যে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের বিপথে নেওয়া হয়েছে সেই বিষয়গুলো তাদের বুঝিয়ে বলার জন্য ইসলামিক ক্লারিকস বা আলেম। তাদের নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।”

জঙ্গিবাদবিরোধী এতসব পদক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিক গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সে বাংলাদেশ এখন ৪০তম অবস্থানে রয়েছে বলে জানান আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, “অনেক উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের চেয়ে আমাদের অবস্থান ভালো। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে নিরাপদ দেশ।”

সিডনি ভিত্তিক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস’ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সূচক গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স প্রকাশ করে প্রতিবছর।

গত মার্চে সংস্থাটি ২০২২ সালের যে সূচক প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ নম্বরে। সবচেয়ে সন্ত্রাসপ্রবণ দেশে হিসেবে প্রথম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। পাকিস্তানের অবস্থান ১০ নম্বরে, ভারত ১২ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ২৫ নম্বরে আর নেপাল আছে ৩৪ নম্বরে।

মানুষ তথ্য দিচ্ছে

হলি আর্টিজানে হামলার পর সেই রাতে যে পুলিশ কর্মকর্তারা সবার আগে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন, ছানোয়ার হোসেন তাদের একজন। এখন পুলিশের বিশেষায়িত শাখা- অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) অপারেশন্স বিভাগের পুলিশ সুপার তিনি।

এরা এখন স্মৃতির পাতায়; গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন তারা।

ছানোয়ার বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর মানুষ বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সচেতন হওয়ার কারণে মানুষ এখন উগ্রবাদীদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিচ্ছে। বিগত সময়ে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন বলে জানান ছানোয়ার।

সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তথ্য পেতে র‌্যাব বানিয়েছে ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপলিকেশন। সিটিটিসির রয়েছে ‘হ্যালো সিটি’ নামের পৃথক অ্যাপ।

অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের রয়েছে ‘ইনফর্ম এটিইউ’ নামে আরেকটি অ্যাপ। গুগল প্লে-স্টোর থেকে সিটিটিসি ও এটিইউর অ্যাপ দুটি ১০ হাজারের বেশি বার ডাউনলোড করা হয়েছে বলে তথ্য দেখাচ্ছে। এছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমেও পুলিশ এখন তথ্য পাচ্ছে।

ছানোয়ার হোসেন মনে করেন, মানুষ সচেতন হলেই দেশ থেকে জঙ্গিবাদের ‘মূলোৎপাটন’ সম্ভব।