উগ্রবাদীরা অনলাইনে ডেকে যাচ্ছে, তবে সাড়া পাচ্ছে না: সিটিটিসি প্রধান

উগ্রবাদীরা অনলাইনে সক্রিয় থাকলেও ‘সাইবার প্যাট্রোলিং আর তরুণরা আগের চেয়ে সচেতন হওয়ায়’ তারা সফল হচ্ছে না বলে দাবি করছে পুলিশ।

গোলাম মর্তুজা অন্তু জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2022, 07:27 PM
Updated : 1 July 2022, 04:04 AM

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, মাঠপর্যায়ে জঙ্গিদের তৎপরতা এখন ‘একেবারেই শূন্য’। আর অনলাইনে জঙ্গিরা তাদের মতাদর্শ ছড়িয়ে বিশেষ করে তরুণদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা এখন অনেক সচেতন।

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ছয় বছরকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার।

আসাদুজ্জামান বলেন, “দেশের কোথাও জঙ্গিদের ফিজিক্যাল কোনও তৎপরতা নেই। সিটিটিসিসহ যারা জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় কাজ করছেন তাদের তৎপরতার কারণে উগ্রবাদীদের ফিজিক্যাল একটিভিটিজ একেবারেই জিরো।

“তাদের সার্বিক কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বিগত দুই বছর ধরে দেশে কোনও জঙ্গি হামলার ঘটনা নেই। জঙ্গিদের যদি সক্ষমতা থাকত... তাদের উপস্থিতি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে।

“দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এবং নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার উপায় হচ্ছে কোনো ঘটনা ঘটানো। গত দুই বছরে কোন ধরনের কোনো হামলার ঘটনা নেই।”

গত বছর মে মাসে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পুলিশ বক্সের সামনে বোমা (আইইডি) উদ্ধারের উল্লেখ করে এমন সবগুলো ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, “পুলিশ বক্সের সামনে তারা যে বোমা (আইইডি) রেখে গিয়েছিল সেই ঘটনাতেও তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের একটা আস্তানায় আরও কিছু বোমা ছিল সেগুলোও উদ্ধার করা হয়েছে।

“তারা বোমা রেখে গিয়ে যতোগুলো চেষ্টা করেছিল প্রত্যেকটা ঘটনাতেই কিন্তু সিটিটিসি তাদের শনাক্ত করে সকলকে গ্রেপ্তার করেছে। একটি ঘটনাও কিন্তু অনুদঘাটিত নেই। সকল জঙ্গিকে আমরা গ্রেপ্তার করে আইনেও আওতায় এনেছি।”

এসব কারণেই আন্তর্জাতিক গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্সে বাংলাদেশের সূচক এখন ৪০ জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, “অনেক উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের চেয়ে আমাদের অবস্থান ভাল। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে নিরাপদ দেশ।

“এ থেকে আমরা বলতে পারি জঙ্গিদের একেবারেই কোনও সক্ষমতা নেই। তারপরও তারা অনলাইনে সক্রিয় আছে। কিন্তু অনলাইনেও আমাদের সাইবার প্যাট্রোলিংয়ের কারণে সেটা কার্যকর না।

“বিগত বছরগুলোতে আমরা অনেককে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করেছি যারা সাইবার স্পেসে উগ্রবাদের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। সাইবার স্পেসে যাদের ‘ত্রিরত্ন’ বলা হতো সেরকম বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি।”

হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে জুন মাস পর্যন্ত সাইবার স্পেসে উগ্রবাদী মতাদর্শ ছড়ানোর অভিযোগে ৪৭২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি।

সিডনি ভিত্তিক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস’ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সূচক গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স তৈরি করে। গত মার্চে সংস্থাটি ২০২২ সালের যে সূচকটি প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ নম্বরে।

সবচেয়ে সন্ত্রাসপ্রবণ দেশ হিসেবে প্রথম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। পাকিস্তানের অবস্থান ১০ নম্বরে, ভারতের ১২ নম্বরে, শ্রীলঙ্কার অবস্থান ২৫ নম্বরে আর নেপাল আছে ৩৪ নম্বরে।

‘অনলাইন র‌্যাডিক্যালাইজেশনে ব্যর্থ জঙ্গিরা’

কিছু উগ্রবাদী পাশের দেশে অবস্থান নিয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এমন তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তরুণদের সচেতনতার বিষয়টি সামনে আনেন অতিরিক্ত কমিশনার।

তিনি বলেন, “তাদের রিক্রুটমেন্ট, তাদের আদর্শ প্রচার প্রচারণা, তাদের ট্রেনিং মডিউল শেয়ার করা এসবকিছুই অনলাইন কেন্দ্রিক। সেটা যেকোন জায়গায় বসেই করতে পারে।

“তবে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন। আগে জঙ্গি সংগঠনগুলো যতো সহজে বা যতো অল্প সময়ে সদস্য রিক্রুট করতে পারতো বা টার্গেট গ্রুপকে সহজে উদ্বুদ্ধ করতে পারত, এখন কিন্তু সেই হারটা অনেক নিম্নগামী।”

কারণ ব্যাখ্যা করে আসাদুজ্জামান বলেন, “তারা বিগত কয়েক বছরে দেখেছে আসলে জঙ্গিদের পরিণতিটা কী। এটা যে ভুল পথ, এটা যে সহজ পথ না এটা আমাদের প্রজন্ম জেনে গেছে।

“আগে জঙ্গিরা যত সহজে তরুণদের দলে ভেড়াতে পারত এখন সেটা সম্ভব নয়। নতুন প্রজন্মের সচেতনতার কারণে তাদের অনলাইন র‌্যাডিক্যালাইজেশনের ক্ষেত্রে তারা এখন অনেকটাই ব্যর্থ।”

এসময় অনলাইনে কোনো কোনো উগ্রবাদী নেতার লাখো ফলোয়ার থাকার কথা উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে কি তাদের কথা তরুণরা শুনছে, কিন্তু মানছে না?

জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, “তরুণরা এখন অনেক বেশি সচেতন। গোড়ামী এবং জঙ্গিবাদ এক জিনিস নয়। দুইটার দুইটা রূপ। জঙ্গি সংগঠনের যে টার্গেট থাকে সংগঠনে ভেড়ানো, সেটা তারা করতে পারছে না।

“হলি আর্টিজানের হামলাকারীদের তারা যেভাবে উদ্বুদ্ধ করে ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিস্ট বানাতে পেরেছিল এখন রিক্রুটাররা ওই পর্যায়ে তরুণদের নিতে পারছে না।”

দুটি জঙ্গি সংগঠনই অস্তিত্বের সঙ্কটে

গত এক দশকে ‘আল কায়েদা’র অনুসারী আনসার আল ইসলাম (পূর্বের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) ও ‘আইএস’ অনুসারী ‘নব্য জেএমবির’ সদস্যরা দেশে বেশ কিছু নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল হলি আর্টিজান বেকারির হামলা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে পাঁচ জঙ্গি পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছিল গুলশানের ওই রেস্তোরাঁয়।

তারা জবাই ও গুলি চালিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। হামলাকারী ওই তরুণেরা ‘নব্য জেএমবির’ সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জানায় পুলিশ।

আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবির বর্তমান অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, “আমি তো আগেই বলেছি যে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা এখন খুবই দুর্বল। নব্য জেএমবিতো এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে।

“যতগুলো অভিযান হয়েছে এসব অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষ ব্যক্তিরা হয় গ্রেপ্তার হয়েছেন না হয় নিহত হয়েছেন। আনসার আল ইসলামেরও একই অবস্থা। বড় কোন নাশকতার সক্ষমতা এখন তাদের নেই।”

জিয়া প্রসঙ্গ

জঙ্গিবাদের প্রসঙ্গে ঘুরেফিরেই আসে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের প্রসঙ্গ। লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উপর হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে পুলিশের তদন্তে তার নাম উঠে এসেছে।

এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় দণ্ডও পেয়েছেন জিয়া। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র আলাদাভাবে জিয়াকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। কিন্তু গত এক দশক ধরেই তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

জিয়াকে কেন ধরা যাচ্ছে না, তিনি কোথায় আছেন- জানতে চাইলে সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, “আমরা তাকে ধরার চেষ্টা করছি।”

তার সর্বশেষ অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অবস্থান জানলে তো আমরা তাকে গ্রেপ্তারই করতাম।” 

আরও খবর