পদ্মা সেতুতে দুর্ঘটনা এবং পুলিশের ছিটমহলের গল্প

স্বপ্নের সেতুতে আনন্দের আবহে শোক নামাল বাইক দুর্ঘটনায় দুই তরুণের মৃত্যু; আর সেই খবর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কৃত হল পদ্মা সেতুর মাঝখানে পুলিশি সীমানার এক অদ্ভুত ছিটমহল। 

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2022, 07:25 PM
Updated : 27 June 2022, 03:17 AM

রোববার ভোরে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর দিনভর পুরো এলাকায় ছিল মোটর সাইকেলের দাপট। শত শত মোটর সাইকেল সেতুর দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় ভিড় করে ছিল পার হওয়ার অপেক্ষায়।

সেতুর উপরও দল বেঁধে, আনন্দ-উল্লাস আর হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ছিলেন মোটর বাইকের আরোহীরা। এর মধ্যে সন্ধ্যার পর দুর্ঘটনার খবর আসে ফেইসবুকে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুই তরুণ সেতুর মাঝখানে বিভাজকের পাশে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। 

ভিডিওতেই আশপাশে পুলিশের কয়েকজন সদস্যকে দেখা গেল। কিন্তু ওই এলাকা কোন থানার এখতিয়ারে পড়েছে, তাই নিয়ে গোল বাঁধল পুলিশ কর্মকর্তাদের কথায়।

মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ (প্রশাসন) সুপার সুমন দেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, তিনি শুনেছেন ২৭ এবং ২৮ নম্বর পিয়ারের কাছে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে ওই এলাকা মুন্সীগঞ্জে নয়, ওপারে পড়েছে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের চার দিন আগেই দুই প্রান্তে উদ্বোধন করা হয় দুটো থানা। এর মধ্যে সেতুর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং প্রান্তের মাওয়া এলাকায় মেদিনীমণ্ডল ও কুমারভোগ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছে পদ্মা সেতু উত্তর থানা। আর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পূর্ব ও পশ্চিম নাওডোবা ইউনিয়ন নিয়ে ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা’। পুরো সেতুর আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব এ দুই থানার ওপরই থাকার কথা।

কিন্তু শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, তার এলাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

“আমার এলাকা ৩৩ নম্বর পিয়ার থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত। এই এলাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।”

বিষয়টি বোঝার জন্য মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেনকে ফোন করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, পদ্মা সেতুর ১ নম্বর থেকে ১৫ নম্বর খুঁটি পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জে পড়েছে। সেটুকুই পদ্মা সেতু উত্তর থানার এখতিয়ারে। দুর্ঘটনা ওই এলাকায় ঘটেনি।”

১-১৫ নম্বর পিয়ার পদ্মা সেতু উত্তর থানায়, ৩৩ থেকে ৪২ নম্বর দক্ষিণ থানায় হলে মাঝের অংশ টুকু কার অধীনে?

এই প্রশ্নে মুন্সীগঞ্জের এসপি মোমেনের উত্তর আসে, “মাঝে যে ১৬ থেকে ৩২ নম্বর পিয়ার আছে, সেটা পড়েছে মাদারীপুর জেলার মধ্যে। ফলে মাদারীপুরের শিবচর থানা এলাকার মধ্যে ওই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলকে ফোন করলে তিনি জানালেন, সেতুর যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলা হচ্ছে, সেটি তার এলাকাতেই পড়ে।

“তবে আমাকে এ ব্যাপারে কেউ কোনো দুর্ঘটনার কথা জানায়নি। এখন পর্যন্ত কেউ রিপোর্ট করেনি।”

তবে দুর্ঘটনার খবর শোনার কথা স্বীকার করলেন শিবচর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমীর হোসেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “সেখানে তো পদ্মা সেতু উত্তর বা দক্ষিণ থানার পুলিশ যাওয়ার কথা। আমাদের সেখানে কেউ যায়নি।”

তার যুক্তি, “যখন পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ চলছিল, তখন আমরা নদীর মাঝ জায়গার অংশটুকু দেখভাল করেছি। এখন সেতু হয়ে গেছে, থানা হয়েছে দুটো। নদীর মাঝ দিয়ে তো আমরা সেতুতে উঠতে পারব না। এটা দেখলে নতুন দুই থানার মধ্যে যে কোনো এক থানাই দেখবে।”

এদিকে সোশাল মিডিয়ায় দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তৎপর হয় সেতু বিভাগ। রাতে এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, “আগামীকাল ২৭ জুন ২০২২, সোমবার ভোর ৬টা থেকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।”

সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতুতে মোটর সাইকেল চলাচল অনেক বেড়ে গেছে, তারা ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল করছে। দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছি। তাই আগামীকাল থেকে মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে।”

দুর্ঘটনায় আহত দুই তরুণকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

যেখানে দুই তরুণের প্রাণ গেল, সেই এলাকা কোন থানার এখতিয়ারে পড়েছে- জানতে চাইলে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জিহাদুল কবির জটিলতার বিষয়টি স্বীকার করে নেন।

তবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা খুব শিগগিরই ডিমারকেশনটা করে ফেলব।”