হাওরে তিন দশকে জলাভূমি কমেছে ৮৭%, বাড়ছে বন্যার ব্যাপকতা: গবেষণা

হাওর এলাকায় গত তিন দশকে ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমে চারশ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে; যে কারণে বন্যার ব্যাপকতা বাড়ছে, তা ভয়াবহও হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2022, 03:19 PM
Updated : 24 June 2022, 03:26 PM

শুক্রবার হাওরের ভূমি ব্যবহার বিষয়ক এক গবেষণার প্রতিবেদন উপস্থাপন নিয়ে আয়োজিত সংলাপে বর্তমান বন্যার প্রেক্ষাপটে হাওর রক্ষায় পরিকল্পিত উন্নয়নের পরামর্শও এসেছে তাদের বক্তব্যে।

এবারের বন্যাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে আর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে তারা মনে করছেন, ক্রমাগত অবকাঠামো বানানোর কারণে হাওরের পানি ধারণ ক্ষমতা কমতে থাকায় হঠাৎ বন্যা ভাসিয়ে দিচ্ছে সবকিছু।

তারা হাওরে অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ থেকে সরে আসতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।

বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর তৈরি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭৩ হাওরে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ ১৯৮৮ সালে ছিল ৩০ হাজার ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। ৩২ বছরে তা কমে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০৭ বর্গকিলোমিটারে।

এসময়ে হাওরাঞ্চলে সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রায় পৌনে চারগুণ বেড়ে ১০৩২ থেকে ৩৮৭২ বর্গকিলোমিটার হয়েছে।

এদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে ’হাওর এলাকার ভূমি ব্যবহারের কয়েক দশকের পরিবর্তন ও এবারের ব্যাপকতা: গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা’ শীর্ষক সংলাপে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

ইনস্টিটিউড ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এ সংলাপের আয়োজন করে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও পরিকল্পনাবিদ ইনজামামউল হক রিফাত ও মারিয়া মেহরিন ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এ গবেষণা করেন।

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাকিল আকতারের তত্ত্বাবধানে ও আইপিডির সহযোগিতায় হাওর এলাকার ১৯৮৮ থেকে ২০২০ সালের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমি এলাকার ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন সম্পর্কিত এ গবেষণা করা হয়। এতে ১৯৮৮, ১৯৯৪, ২০০৬, ২০১৩ ও ২০২০ সালের স্যাটেলাইট ইমেজ ‘ক্লাসিফিকেশনের’ মাধ্যমে তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়।

সংলাপে গবেষণার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, হাওর এলাকায় নির্মিত এলাকা (বিল্ট আপ এরিয়া) ২০০৬ সালে ২ দশমিক ২ গুণ ও ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ গুণ বেড়েছে।

পাশাপাশি পতিত জমি, কৃষি জমি ও বনজ এলাকাও কমেছে আশংকাজনকভাবে। হাওরের বিভিন্ন জেলার মধ্যে ১৯৮৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ সিলেটে ৭৫ ভাগ, সুনামগঞ্জে প্রায় ৮০ ভাগ, নেত্রকোনায় প্রায় ৯০ ভাগ, কিশোরগঞ্জে প্রায় ৮৫ ভাগ, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় প্রায় ৭০ ভাগ, হবিগঞ্জে প্রায় ৯০ ভাগ এবং মৌলভীবাজারে প্রায় ৭০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে বলে গবেষণার তথ্য।

পানি সম্পদ বিভাগের ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, সাত জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে, যার মোট পরিমাণ আট লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯৫ হাওরে জলাভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর।

অধ্যাপক আদিল বলেন, আগের বছরগুলোর চেয়ে বর্তমানে বন্যার ভয়াবহতা আরও বেশি হওয়ার কারণ অতিবৃষ্টি ও নদী-নালার নাব্য সংকটের পাশাপাশি জলাভূমির ভরাট করে বাড়িঘর ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় যা বন্যার ঝুঁকি তৈরি করে।

অপরিকল্পিতভাবে সব হাওরাঞ্চলে নির্মাণ কাজ চালানোর কারণেই মূল ক্ষতি হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, হাওরের জলাভূমি ধ্বংসের মূল ক্ষতিটা হয়েছে ২০০৬ থেকে ২০১৩ সময়কালে; যখন ২৮ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে।

“২০১২ সালে হাওর এলাকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন হবার পর এই ধ্বংসের পরিমাণ কিছুটা কমতে থাকে।“

তিনি বলেন, “হাওর এলাকা রক্ষা ও প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের যথাযথ তদারকির মাধ্যমে হাওর অঞ্চল কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব। সারা বাংলাদেশের হাওর এলাকার ভূমি রক্ষা করা ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে বন্যা ব্যবস্থাপনা ও প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভবপর নয়।”

আইপিডির পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম আগামীতে হাওরে কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তা না হলে আরও অনেক দুর্যোগের মুখে পড়তে হবে।

পরিকল্পনাবিদ রিফাত বলেন, স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে নানাবিধ চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করেই এই গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে। হাওর এলাকার জলাভূমির আশংকাজনক পরিবর্তন এখনই রোধ না করা গেলে এই এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি বন্যার আশংকা আও ব্যাপকতর হবে।

সংলাপে বক্তারা সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলের অতি সাম্প্রতিক বন্যায় ভয়াবহতা ও ব্যাপকতার পেছনে অতিবৃষ্টির পাশাপাশি হাওর এলাকার জলাভূমি নষ্ট হওয়ার অনেক দায় রয়েছে বলে মনে করেন।

আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পরিকল্পনাবিদ ফরহাদুর রেজা।