সেই ওকাম্পো এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত: শেখ হাসিনা

পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে পর্যবেক্ষণে আসা বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো নিজেই এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2022, 01:37 PM
Updated : 22 June 2022, 01:58 PM

নিজেদের অর্থায়নে নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু ‍উদ্বোধনের তিন দিন আগে বুধবার নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন সরকার প্রধান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান লুই মোরেনো ওকাম্পোকে ঢাকায় পাঠায়। ওকাম্পো ঢাকায় এসে আমাদের দুর্নীতির খোঁজ করে। এবং বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করেন।

“তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে এবং তাদেরও দোষী সাব্যস্ত করে।

“এমনকি আমাদের দুর্নীতি হয়েছে বলে তারা তদন্ত করতে আসে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “আপনারা বোধহয় একটা জিনিস জানেন, ওকাম্পো কিন্তু নিজেই এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এটা কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা। সে কিন্তু এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত।”

বিশ্ব ব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর ভর করে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার।

সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে বিশ্ব ব্যাংক। টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্থাটি অর্থায়ন স্থগিত করলে তদন্ত শুরু করে দুদক।

ওই তদন্ত পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান আইনজীবী ওকাম্পোর নেতৃত্বে ২০১২ সালে দু’দফায় বাংলাদেশে আসে তিন সদস্যের বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্যানেল।

পর্যবেক্ষক দলের পরামর্শে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দুদকের করা মামলায় জেল খাটতে হয় সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে। পরে অবশ্য দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

২০১৭ সালে কানাডার একটি আদালতও বিশ্ব ব্যাংকের আনা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রমাণ পায়নি বলে জানায়। যদিও দীর্ঘদিনের টানপোড়েনে এই প্রকল্পে দাতাদের অর্থায়ন আর হয়নি।

বিশ্ব ব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান গাব্রিয়েল ওকাম্পোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংকের অন্য অভিযোগের ফলাফল নিয়েও বুধবার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমরা দুদককে তদন্ত করার নির্দেশ দেই। দুদক তারা তদন্ত করে কোনো দুর্নীতি পায় না। এরপর বিশ্ব ব্যাংক কানাডার আদালতে একটা মামলা করে, এই দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এসে।

“কিন্তু কানাডার আদালত সেই তদন্তে কিছুই পায়নি। এবং তারা যে রায় দেয়, সেখানে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, বিশ্ব ব্যাংক যে অভিযোগ করেছে সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া, মিথ্যা এবং বানোয়াট।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই সেতু নির্মাণে আমাদের কেউ দুর্নীতি করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া, তখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংক কিন্তু কোনো টাকাও ছাড় দেয়নি।

“কিন্তু তারপরেও, আপনারা জানেন, এটা নিয়ে আমাদের কয়েকটা বছর সময় নষ্ট করে।”

বিশ্ব ব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান গাব্রিয়েল ওকাম্পো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রথম প্রধান প্রসিকিউটর ছিলেন। আশির দশকে নিজ দেশ আর্জেটিনার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিচারের সময় ডেপুটি প্রসিকিউটরও ছিলেন তিনি।

এক সময় হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের কার সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস পলিসি’র সিনিয়র ফেলো হিসাবে দায়িত্ব পালন করা ওকাম্পো’র অভিজ্ঞতা আছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর।

আইসিসি’র প্রসিকিউটর থাকাকালে অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং করস্বর্গ (ট্যাক্স হেভেনস) নামে পরিচিত দেশ ও এলাকায় তার কোম্পানি থাকার তথ্য উঠে আসে ২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া নথিতে।

ওই সময় ওকাম্পোকে নিয়ে কূটনৈতিক তারবার্তা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষ্য সম্বলিত ৪০ হাজার নথি হাতে আসার কথা জানায় ফরাসি অনলাইন জার্নাল মিডিয়াপার্ট।

ওইসব নথি পর্যালোচনার ভিত্তিতে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ কোলাবোরেশনস (ইআইসি) বলছে, আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার পর সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে কাজ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন ওকাম্পো।

ওকাম্পোর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

৭০ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন আইনজীবী ওকাম্পো প্রথম আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসেন তার দেশের সামরিক জান্তাকে বিচারের মুখোমুখি করায় ভূমিকা রেখে।

২০০৩ সালে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রথম প্রসিকিউটর হন তিনি, এই দায়িত্বে ছিলেন নয় বছর।

তার লক্ষ্য ছিল গণহত্যার দায়ে উগান্ডার গেরিলা নেতা জোসেফ কনি ও সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য লিবীয় নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফিকে বিচারের মুখোমুখি করা।

লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলার মুখে পালিয়ে যাওয়া গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার পর হত্যা করা হয়। চরম নিষ্ঠুরতা ও শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আলোচিত কনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

২ ডিসেম্বর ২০১২: পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল দুর্নীতি দমন কমিশনে যান লুই মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে।

রোমানিয়াভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট বলছে, আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার পর প্রচুর ‘অর্থ কামাচ্ছেন’ ওকাম্পো।

ওই সময় নিউ ইয়র্কভিত্তিক আইন সংস্থা ‘গেটনিক অ্যান্ড গেটনিক’ এ কাজ করার পাশাপাশি ভাইয়ের সঙ্গে ‘মোরেনো ওকাম্পো কনসাল্টিং’ নামে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি।

এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ায় যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ধনকুবের হাসান তাতানাকিকে আইনি সহায়তা দিতে চুক্তি করেন ওকাম্পো।

গাদ্দাফি ও তার ছেলে সাইফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা ওকাম্পো সাবেক গাদ্দাফি অনুসারী তাতানাকির সঙ্গে এই চুক্তি করেন ২০১৫ সালে। তিন বছর সেবা পেতে তিন মিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি দৈনিক মজুরি হিসেবে তাকে পাঁচ হাজার ডলার দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন এ ধনকুবের।

২০১৫ সালের ১২ মে ওকাম্পো তার পক্ষে কাজ শুরু করার ছয় দিনে মাথায় আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর ফাতোস বেনসোডা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির হাতে বেসামরিক নাগরকিদের হত্যা-নির্যাতন ও তাদের হাতে আটক ব্যক্তিদের নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী ও তাতানাকিকে যাতে আইসিসির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয় সেজন্য গাব্রিয়েল ওকাম্পো একটি পথ বাতলে দিতে চেয়েছিলেন বলে তার একটি ইমেইলে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জার্মান অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ডের স্পিইগেল’কে ওকাম্পো ২০১৭ সালে বলেছিলেন, হাসান তাতানাকির সঙ্গে কাজ করা ‘ভালো হবে’ বলে তিনি ভেবেছিলেন।

“তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি লিবিয়ায় শান্তি ফেরাতে চেষ্টা করছেন।”   

লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারকে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে তাতানাকিকে সতর্ক করেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

অফশোর কোম্পানি

ওকাম্পো আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার দুই মাস পর ডাচ ব্যাংক ‘এবিএন আমরো’ তে তার অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার ডলার আসে সুইজারল্যান্ডের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। ‘টেইন বে করপোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ওই অর্থ পাঠানো অব্যাহত থাকে।

‘টেইন বে করপোরেশন’ এর নিবন্ধন রয়েছে পানামায়, এই অফশোর হেভেনে কোম্পানিগুলোর মালিকদের নাম গোপন থাকে। ওকাম্পো ও তার স্ত্রী ওই কোম্পানির মালিক বলে ফাঁস হওয়া নথিতে বেরিয়ে এসেছে।

করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে ‘ইয়েমানা ট্রেডিং’ নামে ওকাম্পোর এবং আরেক করস্বর্গ ‘বেলাইজে লুসিয়া এন্টারপ্রাইজেস’ নামে তার স্ত্রীর একটি কোম্পানি থাকার তথ্যও উঠে এসেছে।

দক্ষিণ আমেরিকায় অফশোর হেভেন হিসেবে বিবেচিত উরুগুয়েতে ‘মোরেনো ওকাম্পো কনসাল্টিংয়ের’ প্রতিষ্ঠান ‘ট্রান্সপারেন্ট মার্কেটস’ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

আইসিসির দায়িত্বে থাকাকালে অফশোর কোম্পানি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ওকাম্পো ডের স্পেইগেলকে বলেন, “অফসোর কোম্পানি অবৈধ নয়। সেগুলোর মাধ্যমে আপনি অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন। কিন্তু সেগুলো অবৈধ নয়।”

নিজের দেশ আর্জেন্টিনায় কোনো ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিরাপদ নয় দাবি করে ওই সময় তিনি বলেন, “বৈধ এবং অবৈধ উভয় কারণেই আপনার অফশোর কোম্পানি থাকতে পারে।

“অর্থ বা ঘুষ নেওয়ার জন্য আপনি একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি হতে পারেন। আবার একজন সৎ আইনজীবী হিসেবে আপনি বাইরে অর্থ রাখতে পারেন।”

আরও খবর