কেন ‘তাদের’ আত্মবিশ্বাসের এত অভাব, প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

দুর্নীতির কথিত অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে দেশে যারা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, নাম ধরে ধরে তাদের বক্তব্যের জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2022, 11:51 AM
Updated : 23 June 2022, 05:06 AM

যুদ্ধ করে বিজয়ী জাতির মনোবল কেন তাদের নেই, সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যে পারে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তিন দিন আগে বুধবার সকালে নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই তার বক্তৃতার একটি বড় অংশে ছিল পদ্মার স্বপ্ন পূরণের ইতিবৃত্ত।

যারা বাংলাদেশের নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না কেন এদের ভেতরে আত্মবিশ্বাসের অভাব? তারা ভুলে যান যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে। আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা যখন একটা কথা বলি, ভেবে চিন্তেই বলি। কারণ বিজয়ী জাতি হিসেবে সেই মানসিক শক্তি নিয়েই কথা বলি।

“কিন্তু উনাদের ভেতর যেন একটা পরাজিত মনোভাব। মনে হয় যেন পাকিস্তানি আমলে এই প্রদেশে একটা যে পরাধীনতার গ্লানি, তারা সব সময় সেই আত্মগ্লানিতেই ভোগেন। এজন্য তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব।”

শেখ হাসিনা বলেন, “কিন্তু আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি যেটা পারব, সেটাই বলব। যেটা বলব, ইনশাল্লাহ সেটা আমি করব। সেটা আমি করে দেখাতে পারি, সেটা আমরা করেছি। এজন্য দেশবাসীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।”

বিশ্ব ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়নের চুক্তি করলেও পরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে, যা নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েন চলে। কিন্তু সেই অভিযোগ তারা প্রমাণ করতে পারেনি।

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় নির্মিত এ সেতুতে এখন যান চলাচাল শুরুর অপেক্ষায় পুরো দেশ। 

সেই সব বচন

প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর কে কোন ভাষায় তার সমালোচনা করেছিলেন, তার বিস্তারিত তালিকা প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন সংবাদ সম্মেলনে।

প্রথমেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনা সভায় বিএনপি নেত্রী বললেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না।’ পদ্মা সেতু হয়েছে।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের বক্তব্য মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৯৬ সালে যখন সরকারে ছিলাম, তিনি আমাদের অর্থ সচিব ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে বললেন, ‘বিশ্ব ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে পরবর্তী ঋণ সহায়তা পাওয়া খুব দুষ্কর হয়ে পড়বে। যখনই কোনো দাতা সংস্থা কোনো নতুন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হবে, তারা দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখবে। সরকার যদি বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে, তাহলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে।’’

শেখ হাসিনা বলেন, “আশা করি পদ্মা সেতুর কাজের মান নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। কাজেই, যে কথা তারা বলেছে, এ কথার কোন ভিত্তি নাই।”

তিনি বলেন, “এখানে খালেদা জিয়া আরেকটা কথা বলেছিল, যেটা ছিল ১৭ অক্টোবর, ২০১১। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করল।

“খালেদা জিয়া নিজেই ভুলে গেছে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টের টাকা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল দুর্নীতির কারণে আর সেই দুর্নীতির সাথে তিনি, তার পুত্ররাও জড়িত ছিলেন… এটা আমাদের কথা না, এটা আমেরিকার এফবিআই কিন্তু এই তথ্যটা বের করেছিল। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের টাকা বন্ধ করে দিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ওই দুর্নীতির কারণে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বদিউল আলম মজুমদার (সুজন সম্পাদক) বলেছিলেন, দুর্নীতি যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের উন্নয়নের ধারাকে নষ্ট করছে, এই ঘটনা তারই আরেকটি উদাহরণ।’

“ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মামলা করেও কিন্তু দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারে নাই। কিন্তু তারা দুর্নীতি দেখেছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “ড. আহসান এইচ মনসুর, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেছেন… ‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না।’

“আমরা কিন্তু শেষ করেছি, তাকেও দাওয়াত দিচ্ছি।”

সরকারপ্রধান বলেন, “ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি। ‘বিকল্প উৎস হতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দৃষ্টি সরানোর উপায় বলে মনে হতে পারে। যদি এই সিদ্ধান্ত সফলও হয়, তাতেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না।’

“বর্তমানে বাংলাদেশের বা আওয়ামী লীগ সরকার আমি চালাচ্ছি। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিকভাবে আছে কিনা আপনারাই বিচার করবেন, বাংলাদেশের জনগণ বিচার করবেন।”

শেখ হাসিনা বলেন, “প্রয়াত বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার বলেছিলেন, ‘নিজস্ব অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নাই।’

“বিএনপি কী বলেছে ওটা আমি ধর্তব্যে নিই না।… ওটা বলে আর সময় নষ্ট করতে চাই না। তবে আমাদের অর্থনীতিবিদ বা বড় বড় জ্ঞানী, গুণীরা কি বলছেন, সেটাই আমি বলি।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ড. সালেহ উদ্দীন, প্রাক্তন গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে, কিন্তু শেষ করতে পারবে না।’

“আমি চাই তাকেও দাওয়াত দিতে। এটা যে শেষ হয়েছে তিনি যেন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে একটু যান। আমি দাওয়াত দিচ্ছি। সবাইকে দাওয়াত দেব। যারা যারা এই কথা বলেছেন, সবাইকে দাওয়াত দেব বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “আইনজীবী শাহদীন মালিক। উনি সব সময়ই স্বাধীন। সব সময় স্বাধীনই থাকেন এবং স্বাধীন মালিক তিনি।…

শাহদীন মালিক স্বাধীন কথা বলেন। তিনি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু দেশী অর্থায়নে হবে না। সম্ভব নয়।’

“সম্ভব হয়েছে। তাকে দাওয়াত দিচ্ছি। তিনি যেন পদ্মা সেতুতে আসেন।”

সরকার প্রধান বলেন, “ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিপিডি, সম্মানীয় ফেলো। তিনি বলেছেন, এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, যা জোগান দিতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না।’

“আমাদের রিজার্ভ কিন্তু এখনো ৪২ বিলিয়ন। আর বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ পড়েনি। সাথে অন্য প্রকল্পগুলো কিন্তু আমরা করে যাচ্ছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, “প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডি, সম্মানীয় ফেলো। তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত সেগুলো আর হবে না।’

“সব কাজগুলো কিন্তু চলছে। কোনটা কিন্তু থেমে যায়নি।”

‘কিন্তু তারা সাহস দেখিয়েছেন’

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ও দেশের সবচেয়ে বড় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেও নেতৃত্ব দেওয়া প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আমাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেল আজকে জামিলুর রেজা সাহেব নেই, আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাই, যখন বিশ্ব ব্যাংক থেকে এই রকম… মহারথীরা সরে গেল কিন্তু তারা কিন্তু সরে যাননি। তারা কিন্তু সাহস দেখিয়েছেন এবং তারা এই উপদেষ্টা প্যানেল, তারা কিন্তু কাজ করেছেন এবং তারা যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াতেন, হয়তো আমরা এটা করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। তারা কিন্তু পিছু হটেননি।”

যারা ওই সময়ে সাহস নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সিদ্ধান্তের পাশে ছিলেন, তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, “আমি অত্যন্ত খুশী হতাম, যদি আজকে জামিলুর রেজা সাহেব বেঁচে থাকতেন, এই সেতুটা দেখে যেতে পারতেন।”