পদ্মা সেতুর রেলপথের জন্য শরীয়তপুর জেলার জাজিরার তার ১৫ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। জমি, বসতবাড়ি আর গাছগাছালি বাবদ সরকারি হিসাবে মূল্য আর ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তিনি।
ভিটেমাটি ছেড়ে সত্তরোর্ধ শাহজাহান বেপারীর ঠাঁই হয়েছে একই এলাকার নওডোবা পুনর্বাসন সাইটে। প্রকল্পের মধ্যে পাওয়া আড়াই শতাংশ জমিতে ঘর তুলে থাকছেন স্ত্রীকে নিয়ে।
আগের কৃষিকাজ আর ক্ষুদ্র ব্যবসার বদলে এখন বাজারে চৌকিদারি আর ছোটোখাটো কাজ করে সংসার চলে এই বৃদ্ধের। খরচে টান পড়লে মেয়েজামাইয়ের দ্বারস্থ হতে হয়।
শাহজাহান বেপারী সংসার চালাতে তার কষ্টের কথা বললেন। কিন্তু পদ্মা সেতুতে তা কী উপকার হবে জানতে চাইতেই তার চোখে-মুখে খেলে গেল এক চিলতে হাসি।
বললেন, ”ঢাকা শহরে সহজে যাইতে পারমু, আল্লায় বাঁচায় রাখলে।”
আগেও ফেরি বা লঞ্চে চড়ে হাঁস-মুরগী আর ছাগল বেচতে ঢাকায় যেতেন শরীয়তপুরের শাহজাহান বেপারী; এবার পথ চলার ঝক্কি কমবে বলে তার আশা।
শাহজাহানের মত তিন জেলার ২২ হাজার ৫৯৩ পরিবারের জমি, বসতভিটা আর ঘরবাড়ি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতুর জন্য উৎসর্গ করতে হয়েছে।
জমি অধিগ্রহণ, বন্দোবস্ত ও হুকুমদখলে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তার মধ্যে একটা বড় অংশ গেছে মৌজা মূল্যের দেড়গুণ দামে জমি নিতে গিয়ে।
অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমি থেকে সরতে হয়েছে ২২ হাজার ৫৯৩টি পরিবারকে। তাদের জন্য জমির মূল্যের বাইরে অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা হিসাবে ৭৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে সরকার।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য সাতটি পুনর্বাসন সাইট করা হয়েছে। সেসব সাইটে এপ্রিল পর্যন্ত ২ হাজার ৯৭৩টি পরিবারকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ১ হাজার ১৪১ পরিবার পেয়েছে অন্য জায়গায় ভিটা উন্নয়নের সহায়তা।
যারা জমি বাবদ টাকা পেয়েছেন, তাদেরকে পুনর্বাসন সাইটের অধিগ্রহণের সময়ের দামে জমি কিনতে হয়েছে। আর যারা জমি বাবদ টাকা পাননি, তাদেরকে প্লট দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে।
পুনর্বাসন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্ব ব্যাংক না থাকলেও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদের তৈরি নিয়মই অনুসরণ করা হয়েছে।
পুনর্বাসন কাজে জড়িত ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) লাইভলিহুড ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট শামসুল হক মৃধা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক যাতে কখনো বলতে না পারে আমাদের এসব ইন্ডিকেটর মানা হয় নাই বা পুনর্বাসন ঠিকমত হয় নাই—সেদিকে লক্ষ্য রেখে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কয়েক ধাপে সহায়তা পেয়েছেন পদ্মা সেতুর ক্ষতিগ্রস্তরা। তার মধ্যে ছিল- অধিগ্রহণকৃত জমির মৌজা মূল্যের দেড়গুণ অর্থ পরিশোধ, জমির বাজার মূল্য বিবেচনায় অতিরিক্ত সহায়তা, ঘর-বাড়ি ও গাছগাছালির ক্ষতিপূরণ এবং ঘর-বাড়ি সরিয়ে নেওয়ার জন্য সহায়তা।
‘নিয়ম মেনে’ করার কারণে পদ্মা সেতুর জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রম ‘খুব সুচারুভাবে’ চলছে বলে শামসুল হক মৃধার ভাষ্য।
নদীশাসনের অংশ হিসাবে পুরাতন ফেরিঘাট এলাকার পানিতে বিলীন হয়েছে তাদের জমি। যেখানে এক সময় ছোটো দোকান চালিয়ে সংসার চালাতেন বর্তমানে ৫৫ বছর বয়সী হারুন।
জমির দাম, ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ আর আর্থিক সহায়তার পর প্রকল্পে জমি পাওয়ায় সন্তুষ্ট তিনি। প্রকল্পের আড়াই শতাংশ জমিতে ঘর তুলে ৯ বছর ধরে বসবাস করছেন তারা।
প্রকল্পের ভেতরে গড়ে উঠা বাজারে চার বছর আগে দোকান তুলে হারুন আগের পেশায় ফিরেছেন। তার ১৯ বছর বয়সী বড় ছেলে পদ্মা সেতুতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন।
ছোট ছেলে পুনর্বাসন সাইটের ঠিক বাইরে যশলদিয়া হাই স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ত। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে থেমে গেছে তার পড়ালেখা।
এখনও থাকা-খাওয়ার সমস্যা ‘তেমন নেই’ হারুন বেপারীর। তবে আগের জীবনের তুলনায় প্রকল্প এলাকার জীবন তার কাছে ‘বন্দির মতই’।
হারুন বেপারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিজেরা ভিটেমাটি হারালেও পদ্মা সেতু সবার উপকারে আসবে, এটাই তাদের প্রাপ্তি।
”আমাদের উপকার হবে। দেশের উপকার হবে। দেশের একটা আয়ের পথ হচ্ছে। আমাদের এলাকাও উন্নত হয়ে যাচ্ছে।”
মাওয়া চৌরাস্তা এলাকার ঘরবাড়ি ছেড়ে যশলদিয়া পুনর্বাসন সাইটে স্থানান্তরিত হয়েছেন লিজা আক্তার। দুই সন্তান আর স্বামী-স্ত্রী মিলে চারজনের সংসার তাদের।
মাদারীপুরের মেয়ে লিজাকে বিয়ের দুই বছরের মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের পুনর্বাসন সাইটে নতুন করে আবাস গড়তে হয়েছে। তাদের আগের জমিতে নির্মাণ হয়েছে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক।
লিজার স্বামী আগে বাস চালকের সহকারী ছিলেন, এখন ঢাকার গুলশানে একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। তাদের দুই সন্তান প্রকল্প এলাকার ভেতরে যশলদিয়া পদ্মা সেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।
প্রকল্প এলাকার আড়াই শতক জমিতে এক তলা বাড়ি তাদের। বাড়ির ছোট পরিসর নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করে গৃহিনীর লিজার মনে। আবার বছর বছর পানির পাম্প নষ্ট হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার কথা জানিয়ে বললেন, সেটার জন্য সবাইকে চাঁদা দিতে হয়।
পদ্মা সেতু হয়ে গেলে মাদারীপুরে বাপের বাড়িতে যেতে দুর্ভোগ কমে আসবে বলে আশা করছেন লিজা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বছরে একবার লঞ্চে যাই। সেতু হলে সুবিধাই হবে। একেবারে চলে যাওয়া যাবে।”
আগে পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় ওষুধের দোকান ছিল যশলদিয়ার পুনর্বাসন সাইট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সুজলের। এখন মাঝেমধ্যে ছোটখাট ঠিকাদারির পাশাপাশি প্রকল্প এলাকা দেখাশোনা করেন তিনি।
প্রকল্প এলাকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সুজল বলেন, “এখানে প্রতিটা লোকেরই কাজকর্ম ওদিকে গিয়ে করতে হয়। একটু অভাব-অনটনের মধ্যে আছে আর কি।”
তবে প্রকল্পের ভেতরে স্কুল, পাকা রাস্তাঘাট এবং কাছাকাছি জায়গায় বড় বাজার ও হাই স্কুলসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় সুবিধা হয়েছে বলে তার ভাষ্য। প্রকল্পের ভেতরে একটি বাজার থাকলেও সেটা তেমন সক্রিয় নয়।
এখন অনেকটা বেকার হয়ে যাওয়ায় কিছুটা কষ্ট আছে সুজল খানের। জমানো টাকা যা ছিল, তাও শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে।
পদ্মা সেতুর ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ নিজেদের ত্যাগ স্বীকারের কথা তুলে ধরে সুজল খান বলেন, “এই বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে, এটাতো সবারই জানা। বৃহত্তর স্বার্থ যদি আপনি পেতে চান, ক্ষুদ্র স্বার্থ আপনাকে ত্যাগ করতে হবে।
”আমরা কেউ ভালো আছি, কেউ খারাপ আছি। বিশেষ করে মনে করেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যে সুবিধাটা পাবে। তারা অনেক কষ্ট করেছে আমাদের সামনে, আমরা দেখেছি। তাদের জন্য আমাদের অনেক ভালো লাগতেছে।”
মাওয়া পুরাতন ফেরিঘাট এলাকার দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল এলাকা থেকে ঘরবাড়ি আর ১০-১২টি দোকান হারিয়েছে কাঞ্চন শেখের পরিবার। জমির দাম আর ক্ষতিপূরণ হিসাবে তারা পেয়েছেন ৩৬ লাখ টাকা। এর বাইরে অতিরিক্ত সহায়তা হিসাবে চার লাখ উঠেছে হাতে।
দোকানভাড়া তুলে আর ছোটখাটো কাজকর্ম করে ভালোই চলত কাঞ্চন শেখের সংসার। এখন মুন্সীগঞ্জের যশলদিয়ার পুনর্বাসন সাইটে আশ্রয় হয়েছে তার।
মায়ের নামে পাওয়া ৫ শতাংশ জায়গার এক অংশে ঘর করে থাকেন স্ত্রী আর দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে। পুনর্বাসন সাইটের ভেতরে ’যশলদিয়া পদ্মা সেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি পেয়েছেন তার স্ত্রী।
স্ত্রীর ছয় হাজার টাকা বেতন আর পুনর্বাসন সাইটের ভেতরে ছোটোখাটো কাজ করে এখন সংসার চলে কাঞ্চন শেখের।
কয়েক পুরুষের জায়গা ছেড়ে আসা এবং গত ৯ বছর ধরে পুনর্বাসন প্রকল্পে বসবাসের জন্য কোনো খেদ নেই তার। ‘ইনকাম সোর্স না থাকলেও’ পুনর্বাসন প্রকল্পের মধ্যে জায়গা আর সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় ‘খুশির’ কথাই তিনি বললেন।
কাঞ্চন শেখের ভাষায়, “সেতু হলে সবকিছু উন্নত হবে, মানুষের যাতায়াতের কষ্ট কমবে। মিল-কারখানা হলে আমরা চাকরি-বাকরিও পাইতে পারি।”
শরীয়তপুরের জাজিরার গফুর মুন্সীর গ্রামে গিয়াস উদ্দিন চোকদারের ৩৩ শতক জমি ও বাড়িঘর অধিগ্রহণ হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য। যার উপর দিয়ে গিয়েছে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক।
২০০৭-০৮ সালের মৌজা দরের দেড়গুণ দামে সরকারের কাছ থেকে পৌনে সাত লাখ টাকার মত পেয়েছেন গিয়াস। বসতবাড়ি আর গাছপালার ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু আর্থিক সহায়তা পেলেও তা জমির বাজার মূল্যের তুলনায় ‘অনেক কম’ ছিল বলে তিনি মনে করেন।
আগের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে নাওডোবা এলাকার পুনর্বাসন সাইটে নতুন আবাস হয়েছে গিয়াস উদ্দিনের। প্রকল্প থেকে পাওয়া ৫ শতক জমির উপর ঘর তুলেছেন, থাকেন স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে।
৭০ বছর বয়সী গিয়াস জানালেন, আগে জমিতে ধান-পাট আর শাকসবজি আবাদ করে তার ‘ভালোই চলত’। এখন তাদের তিন জনের সংসার চলে ছেলের আয়ে, তিনি রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করেন।
কয়েক পুরুষের ভিটেমাটি হারিয়ে ‘কষ্টে’ থাকলেও পদ্মা সেতু হওয়ায় ‘সবার উপকারকে’ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন গিয়াস। তবে নিজেদের কষ্ট লাঘবে কিছু দাবিও রয়েছে এই বৃদ্ধের।
তিনি বলেন, “সরকার আমাদের জন্য যথাসম্ভব করেছে। তবে সেতু থেকে যে টোল উঠবে, সেখান থেকে আমাদের জন্য কিছু করতে পারে। আমরা চাই সরকার সেটা করুক।”
এছাড়া যারা অভাবে আছে, আর যারা কর্মক্ষম নয়, তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করার দাবিও জানান তিনি।
পদ্মা সেতুর টোল থেকে বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য বিশেষভাবে খরচ করার দাবি জানিয়েছেন যশলদিয়ায় পুনর্বাসন সাইট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সুজল খানও।
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু থেকে সরকার অনেক টোল পাবে, ওটা থেকে সেতু খরচ উঠিয়ে লাভ করবে বলতেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য সেই টোল থেকে কিছু অংশ খরচ করার দাবি আমরা জানাচ্ছি।”