ভোট দিচ্ছে কুমিল্লা

সিটি করপোরেশন হওয়ার পর তৃতীয়বারের মত নগর কর্তৃপক্ষে নিজেদের জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লাবাসী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কুমিল্লা থেকে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2022, 02:00 AM
Updated : 15 June 2022, 03:38 AM

নির্বাচন বিশ্লেষকরা এ নির্বাচনকে গত দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর জন্য বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন, সেই সঙ্গে এই ভোট হবে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্যও ‘লিটমাস টেস্ট’।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, বুধবার সকাল ৮টায় নির্ধারিত সময়েই এ নগরীর ১০৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।

সোয়া দুই লাখের বেশি ভোটারের এ নগরে ভোট নেওয়া হচ্ছে ইভিএমে। আর এবারই প্রথম সব কেন্দ্র ও ভোট কক্ষে রয়েছে সিসি ক্যামেরা।

রানী দীঘির পাড়ের ভিক্টোরিয়া কলেজ কেন্দ্রে দেখা গেল সকালে ভোট শুরুর আগেই বেশ লম্বা লাইন পড়েছে ভোটারের। সেখানে ৩ হাজার ৮৭ জন নারী ভোটার ভোট দেবেন বলে জানালেন প্রিজাইডিং অফিসার মো. মিজানুর রহমান।

ভোট শুরুর পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোনো সমস্যা নেই। সুন্দরভাবেই শুরু হয়েছে ভোটগ্রহণ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার আরও বাড়বে।”

সকালে কুমিল্লার আকাশে মেঘ থাকলেও সেটা বৃষ্টি ঝরানোর মত নয়। সড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। রাস্তায় মানুষের চলাচল খুব বেশি নেই, তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দৃশ্যমান সর্বত্র।

কুমিল্লা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, ভোর ৬টা থেকেই ১০৫টি কেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট শেষ করার ‘সব ধরনের প্রস্তুতিই’ তারা নিয়েছেন।

বিএনপি দলীয়ভাবে এ ভোটে না থাকলেও দল ছেড়ে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দুইজন। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীতো আছেই। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তাপও আছে। তবে প্রচারের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোথাও কোনো গোলযোগ হয়নি, ভোটের দিনও বড় কিছু ঘটার কোনো শঙ্কা ইসি কর্মকর্তারা দেখছেন না।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “ ঢাকায় ইসি সচিবালয় থেকে এবং রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করা হবে ভোট পরিস্থিতি। কোনো ধরনের অনিয়ম বা গোলযোগের সুযোগ নেই; কমিশন তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেবে।

“ইভিএমে যাতে সুন্দরভাবে ভোটারা ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। ভোট দিতে শ্লথগতি বা কোনো ধরনের ত্রুটি যাতে না হয়, সে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আঙ্গুলের ছাপের পাশাপাশি এনআইডি নম্বর দিয়েও যাতে ভোট দিতে পারে, সে ব্যবস্থা থাকায় দ্রুত ভোট গ্রহণ হবে।”

 

কুমিল্লার ভোট : এক নজরে

>> ভোটার: ২,২৯,৯২০ জন (পুরুষ ১,১২,৮২৬; নারী ১,১৭,০৯২ ও হিজড়া ২)

>> ওয়ার্ড: সাধারণ ২৭, সংরক্ষিত ৯

>> ভোট কেন্দ্র: ১০৫

>> ভোট কক্ষ: ৬৪০।

>> আইনশৃঙ্খলা বাহিনী- ৩ হাজার ৬০৮

>> ৭৫টি চেকপোস্ট, ১০৫টি মোবাইল টিম, ১২ প্লাটুন বিজিবি, ৩০টি র‍্যাবের টিম, অর্ধশতাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, নয়জন বিচারিক হাকিম।

>> প্রার্থী: মেয়র ৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর ১০৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর ৩৬ জন।

মেয়র প্রার্থীরা

>> রাশেদুল ইসলাম- ইসলামী আন্দোলন (হাতপাখা)

>> কামরুল আহসান বাবুল- স্বতন্ত্র (হরিণ)

>> মো. মনিরুল হক সাক্কু- স্বতন্ত্র (টেবিল ঘড়ি)

>> নিজাম উদ্দিন কায়সার- স্বতন্ত্র (ঘোড়া)

>> আরফানুল হক রিফাত- আওয়ামী লীগ (নৌকা)

প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহরের কান্দিরপাড় এলাকা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

লিটমাস টেস্ট

নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার চার মাসের মধ্যে বুধবারই প্রথম ভোট হচ্ছে। এর মধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সঙ্গে পাঁচ পৌরসভা, ১৩০টি ইউপি ও এক উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। তবে প্রচারে সামনে রয়েছে বড়, অর্থাৎ কুমিল্লার নির্বাচনই।

‘ভোটের মাঠে সাক্কু পরীক্ষিত লোক, নির্বাচন কীভাবে করতে হয় এবং কীভাবে জিততে হয়, সে ভালো জানে,” বলছিলেন কুমিল্লা শহরের কালিবাজারের বাসিন্দা মো. ফয়সাল। কিন্তু দুই বার বিজয়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কুও এবার পরিস্থিতি দেখছেন ‘ভিন্ন’।

একে তো দলেরই এক নেতা প্রতিদ্বন্দ্বী, তার ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতার ‘আশীর্বাদ’ও এবার তার উপর থাকছে না। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন মেয়র পদে থাকায় নানা সমালোচনা জমেছে, ফলে সাক্কুর হ্যাট্রিক জয়ের স্বপ্ন পড়েছে বড় পরীক্ষায়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সাক্কুর মতো বড় পরীক্ষায় যে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনও, তা বললেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।

তার কথায়, “এ নির্বাচন নবগঠিত ইসির জন্যে প্রথম লিটমাস টেস্ট। ভবিষ্যতে নতুন কমিশনের ইমেজ গঠনের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করবে এ নির্বাচনের উপর।”

নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে ক্ষমতাসীন দলের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে এলাকাছাড়া করতে না পারলেও নির্বাচন কমিশন বলছে, অবাধ সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে আগামীর জন্য একটি উদাহরণ দেওয়ার মতো ভোট করতে চান তারা।

সব দলের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া ইসির জন্য এই নির্বাচনকে বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন ভোট পর্যবেক্ষকরাও।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম বলেন, “এ পর্যন্ত বেশ সন্তোষজনক। শেষদিকে একজন সংসদ সদস্যকে নিয়ে আচরণবিধি প্রতিপালনের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বেশ। সব কিছু ছাপিয়ে ভোটের দিনের পরিবেশ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার উপর আগামী দিনের নির্বাচনগুলো কেমন হবে তা নির্ভর করবে।”

সেই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার কতখানি হচ্ছে, তার সফলতায় প্রভাবও কুমিল্লার ভোট ফেলবে বলে মনে করেন কলিমুল্লাহ।

বিএনপিসহ নানা দলের প্রশ্ন থাকলেও ২ লাখ ৩০ হাজার ভোটারের কুমিল্লায় ১০৫টি কেন্দ্রের ৬৪০টি ভোট কক্ষেই সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েও মেয়র হওয়ার লড়াইয়ে নামা মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার দুজনই ইভিএম নিয়ে সন্দিহান হলেও সিসি ক্যামেরা বসানোয় কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

এর আগে ভোটকক্ষের গোপন কক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উপস্থিতির মধ্য দিয়ে ভোটে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠলেও তা সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে এড়ানোর পথ তৈরি হবে বলে আশাবাদী ইসি।

ইসি থেকে জানানো হয়েছে, এসব ক্যামেরায় ভোটের আগের দিন থেকে পরদিন মোট ৪৮ ঘণ্টা ধরে ধারণ করা ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষ বাদে ভোটকেন্দ্রের ভিডিও থাকবে ইসির কাছে। কেউ অনিয়ম করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাম থেকে মনিরুল হক সাক্কু, আরফানুল হক রিফাত ও নিজাম উদ্দিন কায়সার

এগিয়ে কে?

কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান মনিরুল হক সাক্কু এর আগে দুই বার সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দুবারই জেতেন। তবে দুবারই তার সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন একজন প্রার্থী। এবার কায়সার প্রার্থী হওয়ায় লড়াই ত্রিমুখী হবে বলে ধারণা কুমিল্লার ভোটারদের।

ভোটের আগের দিন মঙ্গলবার কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে অর্ধশত মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া যায়।

কেউ কেউ বলছেন, এবার ভোটের মাঠে এগিয়ে নৌকা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গত বার যারা আওয়ামী লীগ করেও সাক্কুর নির্বাচন করেছেন এবং সাক্কুকে জয়লাভে সহযোগিতা করেছেন, তারা এবার নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন।

কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদ বরাবরই সাক্কুকে সুবিধা দিত বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। এর আগে প্রথমবার সাক্কুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান। আফজলের মৃত্যুর পর প্রার্থী ছিলেন তারই মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা।

তবে বাবা-মেয়ে দুজনকেই হারতে হয়েছে সাক্কুর কাছে; যদিও সীমা ভোটের ব্যবধান ৩৩ হাজার থেকে কমিয়ে ১১ হাজারে এনেছিলেন। সাক্কুর জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য বাহারের ছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে সাক্কু ভোটের কয়েক দিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এখন বাহার ভাই আমার পক্ষে না থাকলেও মানুষ বলে তিনি আমার পক্ষে ছিলেন, এটা তো আমি অস্বীকার করতে পারব না।”

তবে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এমপি বাহারের ‘লোক’ হওয়ায় আগের পরিস্থিতি আর নেই বলে মনে করেন ভোটাররা।

সাক্কুও বলছেন, “এবার তো পরিস্থিতি অবশ্যই ভিন্ন। এবারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বাহার ভাইয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লোক। তিনি প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন। তাই পরিস্থিতির তো কিছুটা পরিবর্তন হয়েছেই।”

আবার বিএনপির অনেকে কায়সারের পক্ষে কাজ করছেন বলে জানালেন সুজানগরের বাসিন্দা মোহাম্মদ বাবুল।

তিনি বলেন, “অনেকে আবার তার (সাক্কু) প্রতি নাখোশ হয়ে ঘোড়ার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে।”

কালিবাজারের বাসিন্দা ফয়সালের মতো নানুয়া দিঘিরপাড়ের পঞ্চাশোর্ধ্ব ইকবাল হোসেন আবার সাক্কুর হ্যাট্রিক জয়ই দেখছেন।

কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান ফারুক রোমেন আবার বললেন, নৌকাই বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।

তবে চকবাজারের এলাকার আব্দুল হামিদ নামে রিকশাচালক বলেন, “আগাম কিছুই বলা যাচ্ছে না। উপরে উপরে মানুষ একদিকে থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে....”