ভোট সুষ্ঠু করতে সরকারের সহায়তা মিলবে, আশায় সিইসি

নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় দলীয় না নির্দলীয় সরকার থাকবে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু করার দিকে মনোযোগী সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল; আর তা আয়োজনে সরকারের সহায়তা পাবেন বলে আশাবাদী তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2022, 02:50 PM
Updated : 13 June 2022, 03:02 PM

সোমবার নির্বাচন ভবনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সিইসির এই বক্তব্য আসে, যে সংস্থাটি বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হচ্ছে না বলে মনে করে।

হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, “আইন-কানুনে যেটা রয়েছে, সরকার আমাদের সহায়তা করতে পারবে। সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ইসিকে সহায়তা করবে এবং আমরা সে সহায়তা নিতে চাইব। আমরা আশা করি, সরকার সে সহায়তা করবে।”

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হওয়ার পর এখন নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন হচ্ছে।

বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

সিইসির সঙ্গে বৈঠকে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানান।

হাবিবুল আউয়াল বলেন, যে সরকার থাকে, সেটাই নির্বাচনকালীন সরকার।

“বর্তমান যে সরকার রয়েছে, তখন তার চরিত্রটা কিছুটা পাল্টে যাবে। কারণ তখন পৃথিবীর সব দেশেই আছে, এটাকে ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট বলে। উনারা রুটিন ওয়ার্কের চেয়ে বেশি কাজ করবেন না। ইসির কাজে সহায়তা করতে হবে।”

বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য আইনি সংস্কারের যে প্রস্তাব টিআইবি দিয়েছে, তা দৃশ্যত প্রত্যাখ্যান করেন হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধী দলের দাবি নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই তাদের। সাংবিধানিক বিষয়গুলো রাজনৈতিক নেতৃত্বই নির্ধারণ করবে।

“নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা এ ধরনের বিভিন্ন সরকার- সেগুলো আমাদের বিষয় নয়। এটা কিন্তু সাংবিধানিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে ওরা দেখবে। আমাদের কাছে নির্বাচনকালীন সরকার, বিদ্যমান যে সাংবিধানিক কাঠামো রয়েছে, যে সরকারটা নির্বাচনের ওই সময় থাকবে, সে সরকারই আমার কাছে নির্বাচনকালীন সরকার।”

“পৃথিবীতে সব তো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। ভারতে হচ্ছে, আমেরিকায় হচ্ছে। সরকারটা কিন্তু দলীয় সরকার নয়, সরকার হচ্ছে সরকার। দল ভিন্ন জিনিস। আমরা এ বিভাজনটা স্পষ্ট করতে পারি,” বলেন সিইসি।

সরকার আর দলের আলাদা সত্ত্বার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “সরকার ও দল এক নয়। যদি আমরা সরকার, দল, রাষ্ট্র অনেক কিছুকে গুলিয়ে ফেলি। বাইরে উনারা আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারে। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে উনারা সরকারের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করবেন, কোনো দলের মন্ত্রী হিসেবে নয়। তারা কিন্তু শপথ নিয়েছে- সংবিধান অনুযায়ী সম-আচরণ করব, দায়িত্ব পালন করব, পক্ষপাতিত্ব করব না।

“উনারা শপথটা জানেন। নির্বাচনের সময় অন্তত সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের স্বার্থে উনারা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে সরকারিভাবে আচরণটা করবেন। তখন আমরা চেষ্টা করব- উনাদেরকে যতটা নিরপেক্ষ করা যায় এবং সুন্দর নির্বাচনের স্বার্থে, সরকারও চাইবেন।”

সিইসির ভাষ্য, কমিশন চায় নির্বাচন সুন্দর হোক, গ্রহণযোগ্য হোক। সরকারও সে সহায়তা করবে বলে তিনি আশাবাদী।

নির্বাচনকালীন সরকারের সময় অগ্রাধিকারমূলক তিন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে কমিশন কাজ করবে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকদের দেখভাল করে জনপ্রশাসন, পুলিশকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্রবাহিনীকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

সিইসি বলেন, “পুলিশ, জনপ্রশাসন প্রয়োজন হতে পারে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়- এ জায়গাগুলোর সহায়তা। অন্য কোনো মন্ত্রণালয় নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় নেই।”

নির্বাচনকালে ক্ষমতায় যেই থাকুক, ইসি সংবিধান অনুযায়ী তার ক্ষমতার প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, “সরকারে যারা থাকবে আইনে আমাদের ক্ষমতা রয়েছে- সরকারের সে সহায়তা নিতে পারবো; পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। নির্বাচন যদি সহিংসতার কারণে বিঘ্নিত হয়ে যায়, আমাদের ক্ষমতা রয়েছে সেখানে কেন্দ্র, পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করে দিতে পারব।”

আচরণবিধি প্রতিপালনের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা চাইব সহিংসতা যেন না হয়। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে। …সংসদ নির্বাচন হবে, তখন সংসদ সদস্যরা এলাকায় থাকবেন। উনাদের সংসদ সদস্য এলাকাতে আচরণবিধি ফলো করতে হবে। এ জিনিসটা আপেক্ষিক। কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব কি পারব না। সবার সহায়তায় আমাদের চেষ্টা থাকবে।”

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমাতে তাদের এক টেবিলে বসানোর দায়িত্ব টিআইবিসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নেওয়ার অনুরোধ জানান হাবিবুল আউয়াল।

“এটা আমরা চাই। (টিআইবি নির্বাহী পরিচালক) উনাকে আমি বলেছি- আপনারা যারা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আছেন। আমরা একবার নিনিয়ানকে (স্যার নিনিয়ান স্টেফান) নিয়ে এসেছিলাম। আপনারাও দায়িত্ব নিতে পারেন, যারা পলিটিক্স করেন না, রাজনীতির ঊর্ধ্বে আপনাদের একটা অবস্থান আছে, আপনারা একটা উদ্যোগ নিয়ে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোকে অ্যাপ্রোচ করতে পারেন।”

রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পরিহারের আহ্বানও জানান সিইসি।

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়া ‘খুবই প্রয়োজন’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যেভাবে হোক,  যদি মূল বিরোধী দল নির্বাচনে না আসে, স্বচ্ছ হোক অস্বচ্ছ হোক- যাই হোক, ওটার গুরুত্ব, গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে যাবে।

“কারণ গণতন্ত্রের কথাই হচ্ছে পজিশন আর অপজিশন। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে যেটা দেখি মানুষের পার্ট অব গর্ভমেন্ট নয়, যেটা নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসে সেটাই পার্ট অব গর্ভমেন্ট, লেজিসলেচার। লেজিসলেচারে যারা বিরোধী দলে থাকেন ওরাও কিন্তু গভর্নমেন্ট।”

ইসি চাইলে পারে: টিআইবি

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন কমিশন যেভাবে মনে করেন- একটা নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সেটি সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনাপ্রসূত পরামর্শ সরকারকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিতে পারেন।”

কমিশনের কাছে টিআইবি আগেই বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তারই ভিত্তিতে আজ আলোচনা করেছি। দেশবাসী চায়- আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেনো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের মাধ্যমে যেন নির্বাচনটি হয়।

“এজন্য অন্যতম পরামর্শ হচ্ছে- নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র কেমন হবে, আচরণ কেমন হবে, গঠন কেমন হবে। বিষয়গুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কথা তুলে ধরিনি। বিষয়টা যেহেতু দেশবাসীর উদ্বেগের জায়গা- সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কমিশনকে বলেছি।”

বৈঠকে টিআইবির তরফে প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার আনার অনুরোধ জানানো হয়।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্য, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা স্বপদে বহাল থেকে নির্বাচন করতে পারেন- তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয় বলে অনেকেই মনে করেন। এটিকে পরিবর্তনের প্রস্তাব কমিশন করবে কি না তা ভাবনায় রাখতে বলেছে টিআইবি।

এক প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “কমিশন অবশ্যই পারে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে পরামর্শ দিতে। ইসি পারে না- এমন কোনো কথা নেই। তারা যদি মনে করে, ইসির নিজস্ব বিশ্লেষণে আইনি সংস্কার করতে পারে, এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব করবেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেটা বিবেচনা করবেন কি করবেন না- তা পরের বিষয়।”

কমিশনের সঙ্গে বৈঠককালে নির্বাচনের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ (ফোরজি থেকে নামিয়ে টুজি) যাতে না করা হয় তার অনুরোধ জানায় টিআইবি। এছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অবাধ সুযোগ, নির্বাচনকালীন তথ্য প্রকাশ, ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইভিএম ব্যবহারসহ নানা পরামর্শ দেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক।