১৩০ মিনিটের বাজেট উপস্থাপনায় অর্থমন্ত্রী বললেন ৫.৩৮%

করোনাভাইরাস মহামারীর খাঁড়া পেরিয়ে কিছুটা পুরনো চেহারায় ফিরল সংসদ অধিবেশনের পরিবেশ; তাতে অর্থমন্ত্রী নিজে বললেন গতবারের চেয়েও কম, ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটে বাজেট জানানো হল মূলত অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায়।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2022, 02:24 PM
Updated : 9 June 2022, 02:27 PM

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই বাজেট পেশ করেন। এটি বাংলাদেশের ৫১তম এবং মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট।

মহামারীর পর যুদ্ধের বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও উন্নয়নের হারানো গতি ফেরার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারে বাজেটের শিরোনাম, ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’।

নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) চেয়ে ১৪.২৪ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৫.২৩ শতাংশের সমান।

বিদায়ী অর্থবছরে মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১২ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৭.৪ শতাংশের সমান।

বৃহস্পতিবার বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

এর আগে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ সভায় বাজেট অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। দুপুরেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবন থেকে আসেন সংসদ ভবনে।

সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংসদ কক্ষে একসঙ্গে হেঁটে ঢোকেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রীর হাতে ছিল লাল রঙের ব্রিফকেস।

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংসদে প্রবেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: পিআইডি

কোভিড মহামারীর ধাক্কা সামলে ওঠার সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্ব বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। খাদ্য আর জ্বালানির দামে ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে ক্রমশ তেজী হতে থাকা ডলার অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে, তাতে অনেক দেশ মন্দার কবলে পড়তে পারে বলে হুঁশিয়ার করছে বিশ্ব ব্যাংক।

নানামুখী চাপের মধ্যেও দেশকে মহামারীপূর্ব উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে নিতে এবারের বাজেট পরিকল্পনা সাজিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

সাধারণত বাজেট পেশের দিনটি সংসদ ভবন জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ। কিন্তু গত দুই বছরের চিত্র ছিল ভিন্ন। সংসদ ভবন এলাকায় প্রবেশে ছিল কড়াকড়ি। আর মূল ভবনে স্বল্প সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেছেন।

অধিবেশনেও চিরচেনা সেই উৎসবের আমেজ দেখা যায়নি দুই বছর। সর্বত্র ছিলো কঠোর সতর্কতা। সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগম ছিল নিয়ন্ত্রিত।

এমনিতে বাজেট উপস্থাপনের সময় সংসদ অধিবেশন কক্ষ পূর্ণ থাকে। তবে গত বছর সংসদে ছিলেন ১৭০ জনের মত আইনপ্রণেতা। তার আগের বছর উপস্থিতি ছিল আরও কম, ৭৮ জন।

তবে এবার অধিবেশন কক্ষে সংসদ সদস্যদের সংখ্যা বেশি গত দুইবারের তুলনায় অনেকটা বেশি ছিল। গত দুই বছর তালিকা করে আইনসভার সদস্যদের সংসদের বৈঠকে বসানো হয়েছিল।

এবার করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেগেটিভ সনদ পাওয়া সব সংসদ সদস্যই অধিবেশন কক্ষে ছিলেন। সব মিলিয়ে সংসদ কক্ষে ছিলেন ২৬০ জন আইনপ্রণেতা।

সংসদ সদস্যদের মুখ ছিল মাস্ক ঢাকা। সংসদ ভবনে প্রবেশ থেকে শুরু করে এমপি লবিসহ সব প্রবেশ মুখে ছিল স্যানিটাইজার। যারাই সংসদে ঢুকেছেন প্রত্যেকের তাপমাত্রা মেপে দেখা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার জন্য নির্ধারিত গ্যালারিতে বসে বাজেট উপস্থাপনা দেখেন। অধিবেশনের শুরুতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির উপস্থিতির কথা সংসদকে জানান।

কোভিড-১৯ নিয়ে সতর্কতা এবারের অধিবেশনে একেবারে উঠে যায়নি। গত ৫ জুন শুরু হওয়া বাজেট অধিবেশনে প্রবেশের ক্ষেত্রে ‘কোভিড নেগেটিভ’ সনদ বাধ্যতামূলক।

গত দুই বছর বাজেট অধিবেশনের সময় অধিবেশন কক্ষে সংবাদর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গত বছর সংসদ ভবনে ঢোকার অনুমতি মিলেছিল। এবার সেই বিধিনিষেধ নেই।

অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল ২০২০ সালে বাজেট বক্তৃতা দিতে সময় নিয়েছিলেন ৪৭ মিনিট। গত বছর এক ঘণ্টার বেশি সময় বাজেট উপস্থাপন করা হলেও নিজে পাঠ করেছেন সব মিলিয়ে ১৫ মিনিটের মত। বাকি সময় পাওয়ার পয়েন্ট এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায় তার বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

এবারও তিনি স্পিকারের অনুমতি নিয়ে স্বাগত বক্তব্য রেখে অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায় বাজেট পেশ করেন। শুরুতে পাঁচ মিনিটের মত বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী। শেষে দুই মিনিটের মত দাঁড়িয়ে কথা বলেন। সব মিলিয়ে ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের বাজেট উপস্থাপনায় মাত্র সাত মিনিট তিনি বক্তব্য দেন।  

দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পরে স্পিকার বলেন তিনি চাইলে বসে পড়তে পারেন। বসে বাজেট উপস্থাপনের প্রাক্কালে কোরানের আয়াত পড়ে শুরু করেন মুস্তফা কামাল।

স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে কোরানোর আয়াত ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলক ওয়া হুওয়া আলা কুল্লিা শাই-ইন ক্বাদীর’ দিয়ে শুরু করেন বাজেট বক্তব্য।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাজেট উপস্থাপনের শুরুতে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির চিরন্তন প্রেরণার উৎস, রাঙালির বরপুত্র, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মৃতুঞ্জয়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি বঙ্গমাতাসহ ১৫ অগাস্টের কালরাত্রিতর সকল শহীদকে, স্মরণ করছি কেন্দ্রীয় জেল খানায় শহীদ চার নেতাকে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সকল নি;শঙ্ক বীরসন্তানদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ত্রিশ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সম্ভব্রম হারানো ২ লাখ মা বোনকে। সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

“আমি আমার বাজে বক্তৃতাটি অডিও ভিজুয়াল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করব। বাজেটে বিস্তারিত তথ্যাদি টেবিলে উপস্থাপিত রয়েছে। পঠিত বলে গণ্য করার জন্য অনুরোধ করছি।”

বাজেট উপস্থাপনার শেষে অর্থমন্ত্রী অর্থবিল-২০২২ সংসদে উত্থাপন করেন। এরপর স্পিকার ১২ জুন বিকাল ৫টা পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন মুলতবি করেন।

গত দুই বছরের মত এবারও বাজেট উপস্থাপনে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আগে বাজেট পেশের সময় কূটনীতিক, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতেন। গত দুই বছরের মত এবারও কাউকে ডাকা হয়নি।

বাজেট পেশের আগের সব আনুষ্ঠানিকতা সারতে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বেলা সাড়ে ১১টায় তার ব্রিফকেস হাতে সংসদ ভবনে উপস্থিত হন।

সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাজেট পেশের পর ১২ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা হবে। ১৩ জুন পাস হবে সম্পূরক বাজেট। এরপর নতুন অর্থবছরের বাজেটের ওপর আলোচনা করবেন সংসদ সদস্যরা।

২৯ জুন নতুন অর্থবছরের অর্থবিল পাস হবে। ৩০ জুন পাস করা হবে বাজেট, তা কার্যকর হবে জুলাইয়ের প্রথম দিন।

গত দুই বছর বাজেট অধিবেশন সংক্ষিপ্ত হলেও এবার শুক্র ও শনিবার বাদে সব দিন সংসদের বৈঠক বসবে। গত বছর সব মিলিয়ে ১২ কার্য দিবস চলে সংসদ অধিবেশন। তার আগের বছর ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম অধিবেশন ছিল নয় কার্যদিবসের।

প্রতিবছর সংসদ ভবনের সাত তলায় গণসংযোগ শাখা থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের বাজেটের নথিপত্র বিতরণ করা হয়। গত বছর সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় নিচের টানেলে বাজেটের নথি বিতরণ করা হয়েছিল। ২০২০ সালের মত এবছর নথি দেওয়া হয় সংসদ ভবনের বাইরে মিডিয়া সেন্টার থেকে।

অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট উপস্থাপন শুরু করার পর সংসদ সচিবালয়ের গণসংযোগ বিভাগ গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বাজেটের নথি বিতরণ শুরু করে।

জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে (www.mof.gov.bd) বাজেটের সব তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রকাশ করা হয়।

সেখান থেকে বাজেট ডকুমেন্ট ডাউনলোড করে পড়া যাবে এবং ‘ফিডব্যাক ফরম’ পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ দেওয়া যাবে।

বাজেট উপস্থাপনের পরের দিন শুক্রবার বেলা ৩টায় ওসমানী মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থমন্ত্রী।