জাতীয় কবিকে নিয়ে আর গেজেটের প্রয়োজন নেই: সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী

জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের স্বীকৃতির জন্য নতুন করে কোনো গেজেটের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2022, 11:17 AM
Updated : 25 May 2022, 11:20 AM

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও জাতীয় কবির স্বীকৃতি নিয়ে কেন গেজেট প্রকাশ হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, “কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, তা আমাদের আইনের মধ্যেই রয়েছে। তার জন্য আর আলাদা গেজেটের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। গেজেটের চেয়ে আইনই বড়।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার সকালে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তাকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু তা নিয়ে কোনো গেজেট প্রকাশ করেননি। এখন নতুন করে আবার গেজেট প্রকাশ হবে কবির প্রতি অবমাননা স্বরূপ।”

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।

বৈচিত্র্যময় এক জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। পিতৃহীন কবি একে একে হারিয়েছেন কাছের স্বজনদের। আর্থিক অসচ্ছলতা তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। 

সব বাধা অতিক্রম করে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। সাম্য ও মানবতার চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল তার লেখনী। কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী কবি’।

নজরুলের জন্মবার্ষিকীর এবারের প্রতিপাদ্য ‘বিদ্রোহীর শতবর্ষ’। জন্মজয়ন্তীর দিনে সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

নজরুল সমাধিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “নজরুল আমাদের মাঝে সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করে গেছেন। আজ জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ এখনও ডালপালা বিস্তার করে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটি সমূলে উৎপাটন করতে হবে।”

বিএনপির পক্ষ থেকে  কবির কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

তিনি বলেন, “আমরা যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি, তখন নজরুল আমাদের প্রেরণা যোগায়। আজকে এই গণতন্ত্র ঘাটতির দেশে স্বৈরতন্ত্র চেপে বসেছে। জনগণের ওপর চেপে বসা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা নজরুলের গান কবিতা রচনা আমাদের উজ্জ্বীবিত করে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা সকালে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শোভাযাত্রা করে কবির সমাধিতে যান এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে কবির সমাধি প্রাঙ্গণে এক স্মরণ সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

সেখানে উপাচার্য বলেন, “শতবর্ষ পূর্বে রচিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার প্রাসঙ্গিকতা অফুরান। যুগে যুগে সমাজের সব ক্ষেত্রে নজরুলের কবিতার তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাই জাতীয় কবি নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা কালজয়ী।”

অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া এবং প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হকের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে একই বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল মূল বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. দেবপ্রসাদ দাঁ-এর নেতৃত্বে বিভাগীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন।

নজরুল সমাধিতে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুরস, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিত, নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জাকীর হোসেনসহ বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার কর্মকর্তারা।

এছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য তাদের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কবির সমাধিতে।

প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি

শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গীক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষণিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।

একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।

নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দখল দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।

সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।

নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।