সম্রাট ফের কারাগারে

জামিনে মুক্তি পাওয়ার ১৩ দিনের মাথায় আবার কারাগারে ফিরতে হচ্ছে ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2022, 08:35 AM
Updated : 24 May 2022, 02:06 PM

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার মামলায় জামিন বাতিল হয়ে যাওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ মঙ্গলবার ঢাকার জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে ফের জামিন চেয়েছিলেন তিনি।

ঢাকার ষষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান জামিন শুনানির জন্য ৯ জুন তারিখ রেখে সম্রাটকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আত্মসমর্পণের জন্য বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে আদালতে আসেন সম্রাট। তার আগেই কয়েকশ সমর্থক আদালতের বাইরে উপস্থিত হন। সম্রাটের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা।

আদালতের আদেশের পর পুলিশের একটি পিকআপে করে সম্রাটকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

শুনানিতে যা হল

গত ১১ মে ষষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতই তিন শর্তে সম্রাটের জামিন মঞ্জুর করেছিল। কিন্তু দুদকের আবেদনে ১৮ মে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ তা বাতিল করে দেয়।

সেই সঙ্গে তাকে সাত দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। জামিনের ক্ষেত্রে ‘যথাযথভাবে নিয়ম না মানায়’ জজ আদালতের বিচারককেও সতর্ক করে হাই কোর্ট বেঞ্চ।

উচ্চ আদালতের আদেশে সম্রাট মঙ্গলবার আত্মসমর্পণ করার পর তার পক্ষে জামিনের আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। অন্যদিকে দুদকের পক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল। 

সমাজী বলেন, দেশ ত্যাগ করা যাবে না, পাসপোর্ট জমা দিতে হবে এবং চিকিৎসার বিবরণ ও চিকিৎসা সনদ দাখিল করতে হবে- এই তিন শর্তে জামিন পেয়েছিলেন সম্রাট।

“জামিন বাতিল হওয়ায় উচ্চ আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সিসিইউ থেকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে এ আদালতে এসে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।

“তিনি মুক্ত বাতাসে মুক্ত বিহঙ্গের মত ছিলেন না। তার জন্য ৬ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। তিনি ওখানকার চিকিৎসকদের মুচলেকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসছেন। চিকিৎসকরা তাকে বলেছেন, তার শরীরের এ অবস্থায় ছোটাছুটি করা উচিৎ নয়। জীবনের ঝুঁকি বাড়বে, যার জন্য চিকিৎসকরা দায়ী থাকবেন না। ।”

সমাজী বলেন, জামিন বাতিল করে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি আগামী ৩০ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির জন্য রেখেছেন।

“আমরাও যেন প্রেজুডিস না হই, আবার উচ্চ আদালতের আদেশের যেন বরখেলাপ না হয়। এ রকম একটি আদেশ আমরা এ বিচারিক আদালত থেকে চাই।”

এর বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “আমরা জামিন আদেশের বিরুদ্ধে  হাই কোর্টে  গেলে  হাই কোর্ট বলেন যে, ‘রং কনসেপশন অব ল’…। নিম্ন আদালতে যে মেডিকেল রিপোর্ট দাখিল করা হযেছিল, তা ফ্রেশ নয়, বরং অনেক আগের।”

এর বিরোধিতা করে সমাজী বলেন, “জাজমেন্টের বাইরে কোনো কিছু বলা সমীচীন নয়।”

কাজল তখন হাই কোর্টের আদেশ পড়ে শুনিয়ে বলেন, “জামিনের বিষয় এখন আপিল বিভাগে পেনডিং। সুতরাং এ মুহূর্তে জামিন নিয়ে কোনো কথা বলাই যাবে না। জামিনের বিষয় আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ সিদ্ধান্ত দেবে। এ আদালত নয় “

এ সময় বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান রাষ্ট্রপক্ষের  কাছে জানতে চান, “তাহলে বর্তমানে আসামির স্ট্যাটাস কি?”

উত্তরে কাজল বলেন, “আমাদের এখানে আর কিছুই করার নেই। আসামি জেলহাজতে যাবে।”

সমাজী তখন বলেন, সম্রাট যে হাসপাতাল থেকে আদালত এসেছেন, তাকে সেখানেই নেওয়ার আদেশ দেওয়া হোক।  

এরপর বিচারক ১৫ মিনিট পরে আদেশ দেওয়া হবে জানিয়ে আদালত মুলতবি করেন। বিরতির পর বিচারক খাসকামরা থেকে এজলাসে আসন নিয়ে হাজতি পরোয়ানা দিয়ে সম্রাটকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আদেশে তিনি বলেন, যেহেতু মামলার ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নেই, এ মামলার পরবর্তী তারিখ ৯ জুন জামিন ও অন্যান্য শুনানি হবে।

মামলা বৃত্তান্ত

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র‌্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে আত্মগোপনে চলে যান দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত এই নেতা সম্রাট।

এরপর ৭ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সেদিন বিকালে সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূইয়া ট্রেড সেন্টারে তার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়।

সেদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অভিযান শেষে গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, ১১৬০টি ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া এবং ‘নির্যাতন করার’ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়ার কথা জানানো হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে।

কার্যালয়ে ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে সম্রাটকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ঢাকার রমনা থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করা হয়। পরে অর্থপাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগেও সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা হয়। 

চলতি বছরের ১০ এপ্রিল থেকে ১১ মের মধ্যে অস্ত্র, অর্থ পাচার, মাদক ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের ওই চার মামলায় জামিন পান তিনি। তাতে ৩১ মাস পর মুক্তি মেলে তার।

মুক্তির আগে প্রায় দেড় বছর কারা তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাধীন ছিলেন সম্রাট। ১১ মে বিকালে জামিনের কাগজপত্র হাসপাতালে পৌঁছালে সেখানেই তার মুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়। মুক্তির পরও তাকে হাসপাতালের 'ডি' ব্লকের সিসিইউতে ভর্তি রাখা হয় অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘হার্টের ক্রনিক অসুখে’ আক্রান্ত সম্রাটকে হাসাপাতালেই রাখার পক্ষে তারা। তবে পরিবার চাইলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্য হাসপাতালে বা বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন। 

কিন্তু দুই সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই সম্রাটকে আবার আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যেতে হল।