তবে পানি কমতে শুরু করায় লাখো মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠা হঠাৎ বন্যার আর ‘অবনতি’ না হওয়ার আভাস দিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
উজানের ভারি বর্ষণের মধ্যে আকস্মিক বন্যায় দুদিন থেকে সিলেটবাসী একপ্রকার ‘হাবুডুবু’ খাচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো বন্যা কবলিত হয়েছে বেশি।
দেশের ভেতরের বৃষ্টিও বাড়িয়েছে দুর্ভোগের মাত্রা। সুনামগঞ্জে হাসপাতালেও পানি ঢোকার খবর এসেছে।
দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষের এমন দুর্দশার মধ্যে একটু হলেও ভালো খবরের আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
তবে সব জায়গায় যে সমানতালে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে তা নয়। কেন্দ্রের পূর্বাভাস বলছে, সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে আগামী এক দিনে।
উজানের ভারি বর্ষণের মধ্যে যখন আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন দেশের ভেতরের বৃষ্টিও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে। এতে এসময়ে মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, উজানের ঢলে এবার বিস্তীর্ণ এলাকায় আকস্মিক বন্যা হল। দেশের উজানেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, দুই থেকে পাঁচ দিনের টানা বর্ষণ এবং একই সময়ে দেশের অভ্যন্তরেও ভারি বর্ষণে নদী-নালা, খালবিল ভরে গেছে। নদ-নদীর পানি উপচে দ্রুত প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল।
“এত অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টি সাম্প্রতিক সময়ে কম হয়েছে। ২০০৪ সালের দিকেও এমন হয়েছে। আগামীতে যে এমন হবে না তা নয়।”
সেই সঙ্গে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে বানের পানিতে। শুক্রবার সকালে পানি ঢুকেছে সুনামগঞ্জ শহরের কালিপুর, ওয়েজখালি, হাজিপাড়া, তেঘরিয়া, নবীনগর, পূর্ব নতুনপাড়া, হাসননগরসহ কয়েকটি এলাকায়।
সিলেটের ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের সড়ক ও সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কয়েক জায়গায়। পানি উঠে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও।
সুনামগঞ্জে বন্যায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতাধীন প্রায় ১৯৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই দুই জেলার নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। বানের তোড়ে অবকাঠামোগত ক্ষতির পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। পানিবন্দি মানুষকে আশ্রয় দিতে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। বরাদ্দ করা হয়েছে শুকনো খাবার ও চাল। পর্যাপ্ত ওরস্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছে বন্যা দুর্গতদের জন্য।
সিলেটের বন্যার মধ্যে সড়কে চলতে হচ্ছে নৌকায়। শাহজালাল উপশহরে বন্যার পানির মধ্যে চলাচল করতে ব্যবহার করা হচ্ছে নৌকা । ছবি: এখলাছ উদ্দিন
সিলেটবাসী এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি বহু দিন। এবার মহানগরেও খারাপ দিকে মোড় নিয়েছে বন্যা।
এর মধ্যে দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে। তাতে শহরের মানুষের খাওয়ার পানির সংকট বেড়েছে। নিচু এলাকায় ঘরের ভেতর হাঁটু পানির কারণে রান্না করতে পারছে না অনেক পরিবার।
বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল বলেন, এপ্রিলের দিকে আগাম বন্যার কারণে ফসলের কিছু ক্ষতি হয়েছে। বাঁধ ঠিকমত সংস্কার না করায় এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
মে মাসের বন্যায় ফসলের তেমন ক্ষতি না হলেও শহরাঞ্চলের দুর্ভোগ বেড়েছে।
“গ্রামের মানুষের সমস্যা কম, তবে গ্রামও এখন কনক্রিট হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে-শহরে যখনই ডেভেলপমেন্ট করছি, তখনই সব সমস্যা মাথায় রেখে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।…
“ঢাকার মত সিলেটও এখন উন্নত শহর হয়ে গেছে। শহরের মেয়রদেরও দায়িত্ব রয়েছে পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার।”
পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে সুনামগঞ্জের ছাতকের কৈতক হাসপাতালের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া আরও দুটি হাসপাতালে পানি ঢুকে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
“বাঁধ বানিয়েছি, পানি নামতে পারে না। জলাভূমি ভরে ফেলেছি। খাল দখল করা হয়েছে। ল্যান্ডস্কেপের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যুক্ত হয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে; এতে দুর্ভোগের শিকার আমরাই।
“আমাদের এদিকে বন্যা হয়েছে, ভারতের আরেক অংশে প্রচণ্ড দাবদাহ, খরা। এটা ভারসাম্যহীনতা। এরইমধ্যে সাইক্লোন আসানি হল, এরপরই হঠাৎ করে বৃষ্টি বেড়ে গেল।”
এমন সমস্যা মোকাবেলায় বন্যার সঙ্গে বসবাস উপযোগী (লিভিং উইথ ফ্লাড কন্ডিশন) করে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরামর্শ দেন অধ্যাপক সাইফুল।
তিনি বলেন, “রাস্তাঘাট, বাড়ি ঘর উঁচু করতে হবে। দরিদ্র মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি সহযোগিতা বাড়াতে হবে। বন্যার আগাম সতর্কবার্তা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাঁধগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।”
নদীর ড্রেজিং করার পাশাপাশি মনিটরিং সুচারু করতে হবে। কৃষকের ক্ষতি পোষাতে ‘ক্রস ইন্স্যুরেন্স’ চালুর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকোশলী আরিফুজ্জামান বলেন, আগেও এ সময়ে আকস্মিক বন্যার দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের এসব এলাকার বাসিন্দাদের। প্রতিবছরই কোনো না কোনো সময়ে এমন পরিস্থিতি হয়।
“এটা অস্বাভাবিক নয়।… খুব দ্রুত বন্যা আসায় হয়ত খেয়াল করতে পারেনি। এ জন্য মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে।”
তাতে উত্তর পূর্বাঞ্চলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জ জেলার নদ-নদীর পানি কিছুস্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
আগামী ২৪ ঘন্টায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তবে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।
আরও পড়ুন: