গাফফার চৌধুরী: বাঁক বদলের সাক্ষী, এক গানেই কিংবদন্তি

“বয়স ৮০ পেরিয়েছে, বেলা ফুরিয়েছে, তবে অতীতের দিকে তাকিয়ে কোনো দুঃখ নেই। আই হ্যাভ নো রিগ্রেট।”

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2022, 05:22 PM
Updated : 19 May 2022, 06:51 PM

বন্ধু সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে এক কথোপকথনে এই কথাই বলেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, আট বছর আগে।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক সে বছরই মারা যান, তার আট বছর পর বিদায় নিলেন গাফফার চৌধুরী।

৮৮ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকারের আন্দোলন পেরিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ- বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক বদলের সাক্ষী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর প্রবাস জীবন বেছে নিলেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি বাংলাদেশ থেকে।

গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, বাংলাদেশে কলাম লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পথ তৈরি করেছেন- এমন নানা গুণে গুণান্বিত গাফফার চৌধুরী।

কিন্তু অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে তরুণ বেলার একটি কাজের জন্যই বাঙালি আর বাংলাদেশের সঙ্গে অনন্তকাল জড়িয়ে থাকবেন তিনি। তা হল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র গানটি রচনা।

গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায়, বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, এই গানটিও ততদিন থাকবে।

তিনি বলেন, “এটি শুধু গান হিসেবেই ব্যবহার করেনি, এটি একটি আদর্শিক দিক উন্মোচন করেছিল। তখন প্রতিঘাত করার প্রয়োজন ছিল, সেটা গানের মাধ্যমে উনি মিটিয়েছেন।”

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালির মিছিলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর গুলি চালানোর পর ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে গিয়েছিলেন গাফফার চৌধুরী। তখন তিনি ঢাকা কলেজে পড়েন।

মেডিকেলের বহির্বিভাগে ভাষা সংগ্রামী রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া লাশ দেখে তার বারবার মনে হতে থাকে, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তখনই তার মাথায় আসে একটি লাইন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।”

এরপর ইতিহাস হয়ে যায় সেই কবিতা। প্রথমে আবদুল লতিফের সুরে তা গানে রূপ নেয়। পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে তা হয়ে ওঠে অবিনাশী ভাষার গান।

এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেই গান কণ্ঠে নিয়ে প্রভাতফেরিতে যায় বাংলাদেশের মানুষ। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থানে উঠে আসে।

ফাইল ছবি

ওই গান লেখার সময় সবে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছেন গাফফার চৌধুরী। জন্ম তার ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার উলানিয়ার জমিদার পরিবারে।

তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় মাদ্রাসায়। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় প্রাথমিকে পড়ার পর হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন।

এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৩ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেন।

ঢাকায় এসেই রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে নিজেও আহত হয়েছিলেন। তবে পরিবার থেকেই আসে তার রাজনীতির চেতনা। তার বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলা কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির সভাপতি ছিলেন।

গাফফার চৌধুরী যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, তখন তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ষষ্ট শ্রেণিতে থাকাকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক নবযুগের ছোটদের পাতায় তার লেখা প্রথম ছাপা হয়। তারপর স্কুলছাত্র থাকাবস্থায়ই তার লেখা কলকাতার সওগাত, ঢাকার সোনার বাংলা (অধুনালুপ্ত) পত্রিকায় ছাপা শুরু হয়।

এসএসসি পাসের পর তিনি যখন ঢাকায় আসেন, তখন সওগাত, মোহাম্মদী, মাহে লও, দিলরুবা প্রভৃতি মাসিক পত্রিকায় তার গল্প-উপন্যাস ছাপা হতে থাকে।

প্রয়াত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী লিখেছিলেন, “কবিতা এবং গানের পাশাপাশি বাংলা কথাসাহিত্যেও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক স্মরণীয় নাম। আজ থেকে ছয় দশক আগে ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তার দুটি গল্পগ্রন্থ কৃষ্ণপক্ষ এবং সম্রাটের ছবিকে এ দেশের কথাসাহিত্যে বাঁকবদলের বিন্দু বলা চলে।”

এক্ষেত্রে ‘সম্রাটের ছবি’ গল্পটি বিশেষভাবে স্মরণ করেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার ভাষ্যে, “স্বাধীন স্বদেশে বহমান ঔপনিবেশিক বাস্তবতাকে যে চারুদক্ষতায় লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ।”

সাহিত্য সমালোচকদের অনেকে বলেন, গাফফার চৌধুরী যদি রাজনীতি আর কলাম ছেড়ে সাহিত্যে মনোনিবেশ করতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হত।

কিন্তু তা হয়নি, তাই তার কাছ থেকে কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস, ছোটদের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী, স্মৃতিকথা কেবল পাওয়া গেছে।

ছাত্রজীবনেই সাংবাদিক হওয়ার পথ ধরেছিলেন গাফফার চৌধুরী। ১৯৫০ সালেই তিনি যোগ দেন ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায়। এর তিন বছর বাদে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মাসিক সওগাতের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হন। দুই বছর পর ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’ সম্পাদনার ভার নেন তিনি। তবে পত্রিকাটি সামরিক শাসনের মধ্যে বেশিদিন বের হতে পারেনি।

গাফফার চৌধুরী এরপর দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক জেহাদ এ কাজ করার পর ১৯৬৩ সালে সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক হন।

এরপর দুই বছর ছাপাখানা খুলে ব্যবসায় নামলেও আবার ফেরেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক আওয়াজ বের করেন। ১৯৬৭ সালে আবার ফেরেন দৈনিক আজাদে। ১৯৬৯ সালে পুনরায় যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। মানিক মিয়া মারা গেলে দৈনিক পূর্বদেশে যোগ দেন তিনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক জনপদ বের করেন। ১৯৭৪ সালে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান তিনি।

তারপর থেকে প্রবাসে থিতু তিনি। সেখানে ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৮৭ সালে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন।

প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে নিয়মিতই লিখে গেছেন গাফফার চৌধুরী; আর এদেশে কোনো সংবাদপত্র বের হলেই পত্রিকার কাটতির জন্য নিয়মিত কলামনিস্ট হিসেবে তার দ্বারেই যেত সম্পাদক-প্রকাশকরা।

একাত্তরে কলকাতায় থেকে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন গাফফার চৌধুরী। কলকাতায় আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায়ও কলাম লিখতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় উনার ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। উনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। এবং আমাদের যে তথ্য বিভাগ ছিল, তিনি সেখানে তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন।

“আমাদের মরহুম নেতা আবদুল মান্নান সাহেবের নেতৃত্বে ওখান একটা প্রকাশনা হয়েছিল। তার মূখ্য ভূমিকা তিনি পালন করেছেন।”

২০০৯ সালের ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বাধীনতা পুরস্কার নেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গাফফার চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতার কথাও তার মৃত্যুর পর স্মরণ করেন জাতির পিতার আরেক সহচর তোফায়েল আহমেদ।

“তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। এবং বঙ্গবন্ধু তাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দেখেছি, তিনি কত গভীরভাবে গাফফার চৌধুরী সাহেবকে ভালোবাসতেন।”

গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা স্মরণ করে তোফায়েল বলেন, “যত ভালো গুণাবলী আছে মানুষের, সব উনার মধ্যে ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন।”

গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার সাবলীল লেখনী ও চোখে ইতিহাসের চমৎকার বর্ণনার কথাই স্মরণ করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন মানুষকে সেই পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমল, বর্তমান সময় থেকে শুরু করে তিনি প্রত্যেকটা মানুষকে জানতেন। ছিলেন স্মৃতিধর। এ মানুষের পূরণ হওয়ার লোক নেই।

“একজন কিংবদন্তি মানুষ যাকে আমরা বলতে পারি যে, তিনি একটা জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া। ইতিহাস যেন ঠোঁঠস্থ ছিল, কণ্ঠস্থ ছিল তার। প্রতিটি সময়, সবকিছু, চমৎকার ভাবে তিনি বর্ণনা করতে পারতেন, বলতে পারতেন।”

বিদেশ থাকলেও দেশের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল গাফফার চৌধুরীর; কোনো ঘটনাই তার চোখ এড়াত না। গত বছর অভিনেত্রী পরিমণিকে ‘হেনস্তার’ প্রতিবাদেও লন্ডন থেকে কলম ধরেন তিনি।

এভাবে দেশের ঘটনাপ্রবাহে তার জড়িয়ে থাকার কথা স্মরণ করে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, “মৃত্যু আমাদের জীবনের পরিণতি হিসেবে দেখি। তার পূর্ণতা দেখা আমাদের সৌভাগ্য।

“শেষ দিকে গাফফার চৌধুরী লিখতে পারতেন না, মস্তিষ্ক সচল ছিল। এতে সর্বশেষ বিষয়টি নিয়েও লেখালেখি করে গেছেন। পরীমনিকে নিয়ে যখন নাটক চলছিল, তখন তাকে সমর্থন করে কবিতাও লিখেছিলেন।”

তোফায়েলের ভাষায়, “ইতিহাসের সৃষ্টির সাক্ষী ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার আকাশে উনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ছিলেন। তার লেখনি বাঙালির হৃদয়ের কথা ফুটতো।”

নিজে কী ভাবতেন গাফফার চৌধুরী; বন্ধু সৈয়দ হকের সঙ্গে কথোপকথনে বলেছিলেন, “আমি একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই। আমি এ কথা বলব না যে, আমি একজন সৎ মানুষ ছিলাম কিংবা অসৎ মানুষ ছিলাম। আমি আঁদ্রে জিদের সেই কথাটা বিশ্বাস করি, আমি যা, তার জন্য আমি নিন্দিত হতে রাজি আছি; আমি যা নই, তার জন্য আমি প্রশংসিত হতে রাজি নই।”

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত গাফফার চৌধুরীর স্বদেশ নিয়ে আশার সঙ্গে কিছু হতাশাও ছিল মনের কোণে। তবে নিরাশ ছিলেন না তিনি।

“আমি নিরাশ নই। আমি সাময়িকভাবে হতাশ। কারণ আমরা যা চেয়েছিলাম, তা আমাদের জীবদ্দশায় বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না,” তা বলার পর কবিতায় লিখেছেন-

মশাল কি নিভে গেল বন্ধু

সূর্যের রংমাখা রোদ্দুর

রক্ত কি মুছে গেল বন্ধু

এই ঘোর অমানিশা কদ্দূর?