প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে জাগছে স্বপ্ন

ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চালিয়ে নেওয়া বরগুনার প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক বিল্লাল হোসেনের দিন কেটেছে মানুষের অবহেলার পাত্র হয়ে, এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের নতুন ঘর পাওয়ার খবরে মা-ভাইকে নিয়ে নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক বরগুনা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2022, 07:18 PM
Updated : 25 April 2022, 07:18 PM

মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীন সব অসহায় মানুষকে নতুন ঘর উপহার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন, তার আওতায় আরও যে ৩৩ হাজার পরিবার নতুন ঘর পেতে যাচ্ছে; সে সব পরিবারেরই একজন ভিক্ষুক বিল্লাল।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প থেকে জানানো হয়েছে, এবার তৃতীয় ধাপে দেশের ৪৯২টি উপজেলার অসহায় পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে বিনামূল্যে দুই শতক জমিসহ সেমি পাকা ঘর করে দেওয়া হচ্ছে।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘর হস্তান্তর করবেন।

তার আগের দিন সোমবার বরগুনা সদরের গৌরিচন্না ইউনিয়নের খাজুর তলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ঘর পেতে যাওয়া মানুষগুলোর উচ্ছ্বাস, অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাদের নিজের একটি ঘর হতে যাচ্ছে। 

নতুন ঘর পেয়ে বিয়ের ইচ্ছাও মনে জেগেছে প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক বিল্লাল হোসেনের।

প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক বিল্লাল (৩২) এবং তার ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী দিনমজুর মো. হানিফ (৩৮) অল্প বয়সেই তাদের বাবাকে হারান। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে এতদিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প ভাড়ার ঘরে থেকে আসছিলেন।

বিল্লাল বলেন, “সারাটা জীবন মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না। ভিক্ষা করে দিন পার করেছি। বাসা ভাড়ার টাকা দিতে না পারলে মানুষ কতটা অবহেলা করেছে। এখন আমারও নিজের ঘর হচ্ছে। মা আর ভাইকে নিয়ে নতুন ঘর সাজাব।”

ঘরে নতুন বউ আনার ইচ্ছা রয়েছে বলেও জানান বিল্লাল।

এই প্রকল্পে খাজুর তলা গ্রামেই নতুন ঘর পেতে যাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের ২২ জন।  

তৃতীয় লিঙ্গের মৌসুমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল অনেক অল্পবয়সে। একেক বয়সে একেক জায়গায় থেকে জীবনের অধিকাংশ সময় পার করে দিতে হয়েছে তাকে।

“ঘর পেয়ে মনে হচ্ছে আমরাও মানুষ, আমরাও এই সমাজেরই অংশ। আমরাও সম্মান,ভালোবাসা পেতে পারি। এটা শুধু সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।”

আগামীতে কৃষিকাজ করার পাশাপাশি একটি গরুর খামার করে জীবন ও জীবিকা চালিয়ে নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানান তিনি।

মৌসুমীর মতো এই এলাকায় নতুন ঘর পেতে যাওয়া তৃতীয় লিঙ্গের অপু, নিপা, নায়লা ও আঁখি বিউটি পার্লার করে বাকি জীবনটা চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন।  

ঘর পেয়ে নিজেদের সমাজের অংশ ভাবতে পারছেন তৃতীয় লিঙ্গের মৌসুমী।

রিকশাচালক মো.জামাল মিয়ার কাছে নতুন ঘর স্বপ্নের মতো।

রিকশাচালক মো.জামাল মিয়ার (৪২) কাছে নতুন ঘর পাওয়া ‘স্বপ্নের মতো’। তিনি বলেন, “নিজের ঘর না থাকায় আমার জীবনে অনেক কষ্ট ছিল এক সময়। অথচ আমার সন্তানের এখন আর কোন চিন্তা নেই...। আমরা সবাই এখন সম্মান নিয়েই বাঁচব।”

প্রায় এক মাস আগে এই এলাকায় নতুন ঘর পাওয়া হোটেল শ্রমিক জাহেদা বেগম (৫০) জানান, তার মা-বাবা-স্বামী কেউ নাই. দুই ছেলেকে নিয়ে তার সংগ্রামের জীবন। টাকার অভাবে ছোট ছেলে রুহুল এসএসএসি পরীক্ষাতেও বসতে পারেনি। কিন্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়ে অভাব কাটছে।

“ভবিষ্যতে দুই ছেলেকে নিয়ে নতুন ভাবে জীবন সাজাব। নতুন করে বাঁচতে পারি এখন। কেউ আর গরিব বলে অবহেলা করে না। আল্লাহ এখন অনেক ভালো রাখছেন বলেন তিনি।”

নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন স্বামীহারা জাহেদা বেগম।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, খাজুর তলা প্রকল্পে মোট ৩২৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় ধাপে নির্মিত ৫০টি ঘর মঙ্গলবার হস্তান্তর করা হবে।

খাজুর তলা প্রকল্পের আওতায়, তৃতীয় লিঙ্গের ২২ জন, ১০ জন ভিক্ষুক, ১৯ জন প্রতিবন্ধী, ২৮ জন বিধবা ও ৪১ জন হিন্দু পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে বলেন জানান তিনি। এই পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ছোটখাটো কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া বলে জানান তিনি।

একইদিন পুরো বরগুনা জেলায় ৪১১টি গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবার ঘর পাবে বলেও জানান তিনি।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানান, ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের পোড়াদিয়া বালিয়া, বরগুনা সদরের গৌরিচন্না ইউনিয়নের খাজুর তলা, সিরাজগঞ্জ সদরে খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের খোকশাবাড়ি, চট্টগ্রামের আনোয়ারার বারখাইন ইউনিয়নের হাজীগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।

তিনি জানান, আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ইতোমধ্যে ২ শতক জমির সঙ্গে ঘর পেয়েছেন দেশের ভূমি ও গৃহহীন প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯ পরিবার।

দেশে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রকল্প নেওয়া হয়। এটির আওতায় ১৯৯৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয় বলে জানান জ্যেষ্ঠ সচিব তোফাজ্জল।