শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল গ্রেপ্তার: ঘটনার পূর্বাপর

শতবর্ষী ওই বিদ্যালয়ে কখনও যা ঘটেনি, তাই ঘটল মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের এক সকালে। শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞানের আলোচনায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে স্কুল চত্বরে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে জড়ো হলেন ছাত্র ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি; হেনস্তা থেকে বাঁচাতে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হল ওই শিক্ষককে, দেওয়া হল মামলা।

মাসুম বিল্লাহগোলাম মর্তুজা অন্তু ও , মুন্সীগঞ্জ থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2022, 03:43 AM
Updated : 10 April 2022, 05:32 AM

ওই মামলায় গ্রেপ্তারের পর হাকিম আদালতে এবং দায়রা জজ আদালতে জামিন মিলল না মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের।

জানাজানি হলে ক্রমে ওই খবর উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে; ক্লাসে পাঠদানের আলোচনাকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার ও জামিন না পাওয়া নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা।

আর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে করা অভিযোগের দুদিন পর হঠাৎ আন্দোলন, গ্রেপ্তার আর জামিন না পাওয়ার বিষয়গুলো মানতেই পারছে না ঘটনার আকস্মিকতা সামলে ওঠা পরিবার ও বন্ধুরা। ঘটনাপ্রবাহ ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সাংসদ। ‘জামিন অযোগ্য ধারায়’ মামলা দায়ের ও ঘটনার পেছনে ইন্ধন দেখছেন স্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা।

গত ২২ মার্চ বিক্ষোভের মুখে ওই বিদ্যালয়ের দেয়ালঘেঁষা বাসা থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে; যিনি তখন স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর থেকে তিনি কারাবন্দি।

এখন থেকে প্রায় ১০৩ বছর আগে ১৯১৯ সালে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়। এ স্কুলেই ২১ বছর ধরে বিজ্ঞান ও গণিত পড়িয়ে আসছেন হৃদয় মণ্ডল। বিদ্যালয়ের সীমানা দেওয়ালের পাশেই শিক্ষক কোয়ার্টারে গত ১০ বছর ধরে থাকছেন তিনি।

শুক্রবার দুপুরে একতলা ভবনটির বাইরে গিয়ে দেখা যায় লোহার ফটক আটকানো। কড়া নাড়ানোর পর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে খুললেন হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদারের ভাই বাদল হাওলাদার।

বোনকে অভয় দিতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী বাদল গত ২২ মার্চ থেকে শতাব্দী প্রাচীন এ বিদ্যালয়ের গ্রেপ্তার শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বাসায় থাকছেন। ভেতরে নিয়ে গেলেন তিনি। হৃদয়ের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে আর পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে সামনে এলেন ববিতা হাওলাদার।

একতলা ভবনটিতে তিনটি ঘর। মাঝের ঘরে হৃদয় নিজে পড়তেন, প্রতিদিন তিন ব্যাচ করে ছাত্রদেরও পড়াতেন। সেই ঘরে তিন জোড়া বেঞ্চ-টেবিল। ঘরের দরজাজুড়ে গণিতের সূত্র হাতে লিখে রেখেছেন। নিজের পড়ার টেবিলের এক পাশে নেলসন ম্যান্ডেলা ও এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুর খবরের পেপার কাটিং সাঁটা।

হাতে লেখা গণিত ও জ্যামিতির নানা সূত্র বিভিন্ন জায়গায় সাঁটানো রয়েছে। পর্যায় সারণী থেকে শুরু করে মানবদেহের কঙ্কালের ছবিসহ বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের পোস্টার ঝুলছে দেওয়ালে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাতাল, গ্লুগান, কাঁচিসহ বৈদ্যুতিক ও দৈনন্দিন কাজের বিভিন্ন যন্ত্র।

ববিতা হাওলাদার জানালেন, শুধু বিজ্ঞান যে পড়াতেন তা নয়, হৃদয় মণ্ডল দৈনন্দিন জীবনেও বিজ্ঞানের চর্চা করতেন। বাড়ির সব ধরনের মেরামতের কাজ নিজের হাতেই করতেন। কাঠের আসবাবপত্রের কাজ বা ইলেকট্রিকের যন্ত্র নষ্ট হলে তিনি নিজেই তা সারিয়ে ফেলতে পারতেন। এজন্য অনেক ধরনের যন্ত্রপাতিও কিনেছিলেন তিনি।

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের পড়ানোর ঘরে গণিত ও জ্যামিতির নানা সূত্র লেখা।

‘আমরা সবাই ঘরবন্দি’

পেশায় নার্স ববিতা কাজ করেন ঢাকার ওয়ারির বারডেম হাসপাতালে। মুন্সীগঞ্জ থেকেই যাতায়াত করেন। ঘটনার পর তাকে অনেকেই এমনকি ‘পুলিশও ঢাকায় চলে’ যেতে পরামর্শ দিলেও তিনি রয়ে গেছেন স্কুল লাগায়ো বাসাতেই।

তিনি বলেন, “কিন্তু আমি যাবটা কোথায়। আমার ছেলেটা এ স্কুলেই ক্লাস ফাইভে পড়ে; স্কুলে গেলেই পোলাপানে বলে ‘আসামির পোলা’। পরে স্যারেরা আমারে বলছে, ছেলেরে কয়েকদিন স্কুলে পাঠাইয়েন না। এখন আমরা সবাই ঘরবন্দি। আমার ভাই বাজার-টাজার করে।”

ঘটনার পর থেকে হৃদয় মণ্ডলের কোনো সহকর্মী বা বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করেনি বলে জানান তিনি। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমার স্বামী কী করছে বলেন তো” সবাই এমন আচরণ করছে যেন ও খুনের আসামি। মামলায় যে কথা লেখা হয়েছে এমন কোন কথা হৃদয় স্যার বলেননি। আমি জেলে গিয়ে দেখা করে আসছি। উনি আমারে অভয় দিয়া বলছে, ‘কিছু হবে না, আমি তো কিছু করিনি।’ ও (হৃদয়) ষড়যন্ত্রের শিকার।”

যা ঘটেছে

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ মার্চ বিরতির পরে দশম শ্রেণির একটি অনির্ধারিত ক্লাসে গিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে কিছু আলোচনা করেন হৃদয় মণ্ডল। একজন ছাত্র বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করে। তিনি সেগুলোর জবাব দেন।

পরে প্রশ্ন ও উত্তরের এ আলোচনা গোপনে রেকর্ড করা হয়; কিছু ছাত্র তা ছড়িয়ে দেয়। ওই পাঠদানের দুদিন পর কিছু ছাত্র ও স্থানীয় ব্যক্তি হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে শুরু করে আন্দোলন। পরে পুলিশ বিক্ষোভের মুখে তাকে থানায় নিয়ে যায় এবং পরে গ্রেপ্তার দেখায়।

ওই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানায়, সেদিন বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাসে এসে হৃদয় মণ্ডল বিজ্ঞান বিষয়ে বক্তব্য দেন। এসময় আলোচনার এক পর্যায়ে ধর্মের প্রসঙ্গ আসে। একজন ছাত্র জানায় যে ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের উৎপত্তি। হৃদয় মণ্ডল ওই যুক্তি খণ্ডন করে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন।

এসময় ক্লাসের আরেকজন ছাত্রের মনে হয় শিক্ষক আলোচনার মধ্যে ‘ধর্ম নিয়ে কটু কথা বলছেন’। সে তার ফোন এগিয়ে দিয়ে আরেক ছাত্রকে (রেকর্ড করেছিল যে) রেকর্ড করতে বলে। রেকর্ড ধারণকারী ছাত্রটির সঙ্গে কথা হলে সে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, শিক্ষকের সামনে থেকেই সে রেকর্ড করছিল।

ক্লাসের আলোচনার অডিও ধারণ করার কথা কেন মনে হল- জানতে চাইলে ছাত্রটি দাবি করে, হেড স্যারের কাছে অভিযোগ দেওয়ার জন্যই তারা তা করেছিল।

‘আর কোনো কারণ ছিল না’ দাবি করে সহপাঠীর ফোনে রেকর্ড ধারণ করা ছাত্রটি বলে, “হেডস্যার যদি আমাদের কথা বিশ্বাস না করে, এইজন্যে (সহপাঠী বন্ধুটি) আমাকে বলল স্যারের কথা রেকর্ড কর। আমরা হেডস্যারকে কমপ্লেন করব।”

পরের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ছাত্রটি জানায়, পরদিন ২১ মার্চ (সোমবার) সে স্কুলে যায়নি। তবে ছাত্ররা এদিন একটি লিখিত অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের কাছে দেয় বলে সে শুনেছে।

এর পরেরদিনের (মঙ্গলবার) ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ছাত্রটি জানায়, পরদিন তাদের যথারীতি ক্লাস চলছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রটি জানালা দিয়ে দেখতে পায় স্কুল চত্বরে ঢুকে কিছু লোকজন শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। তাদের মধ্যে স্কুলের ছাত্রদের কাউকে দেখতে পায়নি জানিয়ে ছাত্রটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “যারা আন্দোলন করতেছিল তাদের চিনি না। বাইরের লোকজন সব।”

এর মধ্যেই ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া হলে সে তার বন্ধুদের নিয়ে বাইরে চলে আসে। পরে কিছু ছাত্র ওই মিছিলে যোগ দেয়। ওই লোকজন কী করে স্কুল চত্বরে এসে স্লোগান দিচ্ছিলেন, সে বিষয়ে ওই ছাত্রের কোনো ধারণা নেই বলে জানায়।

স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মনিরুজ্জামান শরীফ বলেন, “২০ তারিখ ছেলেরা স্কুলে কী করেছে সে বিষয়ে তাদের জানাননি প্রধান শিক্ষক। ২২ মার্চ যখন স্কুলের মধ্যে স্লোগান চলছিল তখন প্রধান শিক্ষক তাকে ফোন করে দ্রুত স্কুলে আসতে বলেন।

“এসেই দেখি কিছু শিক্ষার্থী ও বাইরের লোকজন মিলে হইচই করছে, স্লোগান হচ্ছে। একজন ছাত্রের হাতে জুতার মালাও ছিল। তারা শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে খুঁজছে লাঞ্ছিত করার জন্য।“

নবম ও দশম শ্রেণির অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী ওই আন্দোলনে ‘বড় ভূমিকা’ পালন করে বলে জেনেছেন তিনি।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল জানিয়ে শরীফ বলেন, “তখন শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষকের অপসারণের দাবিও তোলে। স্কুলের কয়েকজন ছাত্র আবার স্কুলের মাইকে বলে ইউনিফরম ছাড়া যারা আছে তারা যেন বাইরে চলে যায়।”

পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্কুলের সাবেক ব্যবস্থাপনা কমিটির কমিটির সদস্য মামুন মিয়ার চালের আড়ত ওই স্কুলের ফটকের পাশেই।

২২ মার্চের ঘটনা নিয়ে মামুন মিয়া বলেন, “সেদিন স্কুলের কিছু ছেলে আর তাদেরই কিছু বন্ধুবান্ধব হবে- বয়সে সবাই তরুণ, তারা জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। আমি স্কুলের গেটে দোকানদারি করতেছিলাম। ঘটনা দেখে আমি দোকান থেকে বের হয়ে গেলাম, তাদের দাবি কী জানলাম। চেষ্টা করেও তাদের থামানো গেল না।

“পরে হেডস্যারকে বললাম পুলিশকে ফোন করতে। পুলিশ এসে হৃদয় স্যারকে নিয়ে গেলে আন্দোলন ঠাণ্ডা হয়।”

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের পড়ানোর ঘর।

পরিবারে তখন কী চলছিল

২২ মার্চ ঘটনার বিবরণ দিয়ে হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা হওলাদার বলেন, “এ ঘটনা যেদিন ঘটে আমি তো রেগুলার ডিউটিতে ছিলাম। আমি তো এ ঘটনা জানিই না। আমার ছেলে ফোন করে বলে স্কুলের অনেক লোক এসে আমাদের দরজায় জোরে জোরে লাত্থি মারছে, বড় বড় লাঠি নিয়ে বাড়ি দিচ্ছে।

“শুনছি যে, ঘটনা ঘটার পরে পোলাপান মিছিল বের করছে। ওর বাবা বাজারে গেছিল। বাজার থেকে স্নান করে এসে এখানে বসছে স্কুলে যাবে। তার মধ্যে এ ঘটনা ঘটছে।”

ববিতা বলেন, “২১ মার্চ বিকাল বেলা হেড স্যারকে একটা অভিযোগ দিছে ছাত্ররা। স্যার বলল, ‘তোমরা এটা দিছো, ঠিক আছে। আমরা হৃদয় স্যারকে তিন দিনের একটা নোটিস দিব। তিন দিনে যদি জবাব না দেয়, তাহলে আমরা কী করা লাগবে, ব্যবস্থা নিব।‘

“ওরা এটা মেনে নেয় নাই। ওরা এটা এলাকার বড় ভাই, মসজিদে মসজিদে এটা ছাইড়া দিছে। ২২ তারিখে ওরা লোকজনকে জড়ো করে। ওরা নিজেরা ঘণ্টা পিটাইছে। ছুটি হইছে ভেবে সব পোলাপান বের হয়ে চলে আসছে। পরে মিছিল হচ্ছিল দেখে পুলিশ ডাকছে। পুলিশ এসে বাসা থেকে হৃদয় স্যারকে নিয়ে গেছে। হৃদয় স্যার তখন বাজার থেকে এসে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল।”

ইন্ধন ছিল কারও?

হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা ধারণা করছেন, এ ঘটনায় কোনও পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে।

তার মতে, হৃদয় মণ্ডল এমন কোনও কথা বলেননি যার কারণে তাকে এতবড় অভিযোগের সম্মুখীন হতে হবে।

এর আগে কখনও এরকম বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে বিতর্ক পর্যন্ত হয়নি জানিয়ে ববিতা বলেন, এর আগে ছেলেরা বাসার দরজায় লাথি মেরে গেছে। জানালা দিয়ে ঢিলও মেরেছে। তবে এগুলোকে তিনি দুষ্ট ছাত্রদের কাজ হিসেবেই দেখেন।

মুন্সিগঞ্জ- ৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসও মনে করেন হৃদয় মণ্ডল ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে কারা এ ষড়যন্ত্র করছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি তিনি।

গ্রেপ্তার ও মামলা যেভাবে, যে কারণে

স্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, তখন কিছু লোকজন খুব ক্ষুব্ধ আচরণ করছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। উত্তেজিত জনতা যেন শিক্ষকের ওপর চড়াও হতে না পারে তারা প্রশাসনকে সেই অনুরোধটাই করেছিলেন। পরে তাকে ভালোভাবেই উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হয়।

উত্তেজিত মানুষকে থামাতে মামলার বিষয়টিও আসে। তখন তারা পুলিশকে বলেছিলেন, এমন একটা মামলা দিতে যাতে পরে জামিন পেতে পারেন হৃদয় মণ্ডল। কিন্তু পুলিশ মামলায় একটি অজামিনযোগ্য ধারাও যুক্ত করে দেয়।

হৃদয় মণ্ডলের আইনজীবী এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা সভাপতি অজয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, “বিষয়টা যখন ঘটল, তখন এটা বাইরে ছড়ায় দিয়ে একটা গোলযোগের সৃষ্টি করল। হয়ত তাদের যে ইন্ধনদাতারা ছিল, তারা বাকি কাজগুলো করছে। পরে খবর দেওয়া হলে প্রশাসন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছে। হেনস্তা হতে দেয়নি।“

পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ সাংসদ

স্থানীয় সাংসদ মৃণাল কান্তি দাস মনে করেন পুলিশের ভূমিকার কারণে এ ঘটনা এতটা ছড়িয়েছে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মনে করি পুলিশের উস্কানিতে জনগণ উত্তেজিত হয়েছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও উস্কানিমূলক আচরণের কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে।”

পুলিশ ওই মামলার এজাহার লিখেছে দাবি করে তিনি বলেন, “একজন শিক্ষক যদি কোনো অপকর্ম করেই থাকেন তাহলে স্কুলে কি হেড মাস্টার নাই? উনি বাদী হতেন। স্কুলের একটা ইলেকট্রিশিয়ান যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না, সে কী করে এ মামলার বাদী হয়। পুলিশ কীভাবে মামলার এফআইআর লিখে দেয়, পুলিশ কীভাবে তাকে গ্রেপ্তার করল?

“ওই ইলেকিট্রিশিয়ান জানেও না ওই মামলার মধ্যে কী লেখা আছে। পুলিশ কি করে মামলা লিখে তার স্বাক্ষর নেয়? এর জবাব কে দিবে?“

মৃণাল কান্তি বলেন, “আমাকে পুলিশ বা পরিবারটির কেউ কিছু জানায়নি। ওই এলাকায় আমার যে লোকেরা আছেন, যারা প্রত্যক্ষদর্শী- তাদের কাছ থেকে ঘটনা জেনেছি। তাতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বা পুলিশ যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে আমি মর্মাহত, লজ্জিত, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ বা আরও যদি কিছু থাকে তা।”

ঘটনার শিকার পরিবারটির পাশে আছেন কি না- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল বলেন, “পরিবারের পাশে সহস্র মানুষ দাঁড়াবে। আমার মত নগন্য একজন মানুষ, একজন কাপুরুষ ও পলায়নপর মনোবৃত্তির এমপি যদি তাদের পাশে দাঁড়াতে নাও পারে দেশের লক্ষ-কোটি মানুষ যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিশ্বাস করেন তারা পরিবারটির পাশে দাঁড়াবে।

“আমি তো সবটাই জানি, সে একটা ষড়যন্ত্রের শিকার। এর চাইতে বেশি কিছু আমি আর না বলি।”

২২ মার্চ হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ থামাতে পুলিশও গিয়েছিল।

ঘটনা যাতে না বাড়ে সেজন্য সব করেছি: এসপি

এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন মনে করেন, পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পুলিশ ওই জায়গায় তাৎক্ষণিক না গেলে ওই লোকটার অবস্থা কী হতো, আপনারা ভেবে দেখছেন একবার?

“ওখান থেকে তাকে রেসকিউ করা টাফ ছিল। তাকে পারলে পুলিশের কাছ থেকেও নিয়ে যায়, এই রকম একটা সিনারিও তারা ওখানে করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে পুলিশের ফল্টটা কী, আমার তো বোধগম্য না বিষয়টা।”

তিনি বলেন, “ঘটনার দুই সপ্তাহ পর আপনি এসে একটা ঠাণ্ডা এলাকা দেখতে পাচ্ছেন। তখন তো আমাদের প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছিল।

“এখানে মানুষ যেরকম উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল তাতে যে কোনো রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারত, মৃত্যু ঘটতে পারতো কারও। এরকম যাতে না হয়, এই ঘটনার রেশ যেন সারা দেশে না ছড়াই সেই চেষ্টাই করেছে পুলিশ।“

মামলার বাদী নিয়ে সাংসদের আপত্তির বিষয়ে এসপি বলেন, “তাকে রেসকিউ করার পর বাকি বিষয় আসে। এখন মামলার বাদী কি হেডমাস্টার হবে, না সহকারী মাস্টার হবে, না দপ্তরি হবে, না কি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হবে... এটা কি পুলিশ ডিসাইড করবে? কে এটা ডিসাইড করবে, আপনি বলেন?”

এ ঘটনা যেন আর বাড়তে না পারে সেজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা পুলিশ করেছে দাবি করে এসপি বলেন, “ঘটনা শোনার পর আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে ঘটনা আর বাড়তে না পারে। আমার দিক থেকে যা করা দরকার, তাতে বিন্দুমাত্র ডিলে করি নাই। শুনতে যতক্ষণ লেগেছে, এরপরই পুলিশ তৎপরতা শুরু করেছে।”

পুলিশের এখনকার তৎপরতা

ওই ঘটনার পরের দুই শুক্রবার জেলা পুলিশের সদস্যরা ছিলেন অনেক তৎপর। পুলিশ কর্মকর্তারা মসজিদে মসজিদে গিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, কথা বলেছেন।

হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদারও বলছেন, ঘটনার পর তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলেও এখন পর্যন্ত কেউ বাসায় এসে চড়াও হয়নি। বাসার আশপাশে পুলিশ ছিল। মসজিদে মসজিদে গিয়েও পুলিশ কথা বলেছে বলে তিনি শুনেছেন।

শুক্রবার দুপুরে ববিতা হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলার সময়ই তাদের বাসায় আসেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মিজানুর রহমান। ওই পুলিশ কর্মকর্তাও কোনো প্রকার সমস্যা বা নিরাপত্তাহীনাতা বোধ করলে তাকে ফোন করতে বলেন।

মিজানুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তদন্ত করছি। পাশাপাশি ওই ঘটনাকে নিয়ে কেউ যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্যও পুলিশ তৎপর রয়েছে। ইউনিফরমড পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে যাচ্ছে। মসজিদে, বাজারে কী কথা হচ্ছে, সে খোঁজও আমরা রাখছি।“

এরকম ঘটনা আগে ঘটেনি

মুন্সীগঞ্জের মানুষ এর আগে কখনও এরকম দেখেনি। রামকুমার বিদ্যালয়ের ১০৩ বছরের ইতিহাসেও এমনটি ঘটেনি। মুন্সীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মীর নাসিরউদ্দীন উজ্জ্বল বলেন, মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুর হচ্ছে প্রাচীন একটা জনপদ। অতীশ দীপঙ্কর থেকে শুরু করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, রাজনীতিক সরোজিনী নাইডু, বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, লেখক হুমায়ুন আজাদ, সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের মত ব্যক্তিত্বরা এ জেলায় জন্ম নিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষ অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞান মনস্ক। এখানকার স্কুলগুলো অনেক পুরনো।

এখানে ১০০ বছরের বেশি বয়স অনেকগুলো স্কুল রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। এখানে এরকম ঘটনা একেবারে অগ্রহণযোগ্য।

হৃদয় মণ্ডলের এ ঘটনা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।

হৃদয় মণ্ডলের ছোট বেলার বন্ধু তপন সরকার বলেন, তারা একসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে কুচিয়ামোড়া হাইস্কুলে পড়েছেন। ১৯৮২ সালে হৃদয় এসএসসি এবং পরে জগন্নাথ কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

তপন বলেন, হৃদয় পড়তে পছন্দ করতেন। বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে তর্কও করতেন। তবে এর আগে কেউ তাকে কখনও ধর্মকে কটূক্তি করা নিয়ে অভিযুক্ত করেনি। হৃদয় মণ্ডলও সযত্নে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতেন।

হৃদয় মণ্ডলের পড়ার ঘরের মধ্যে সাঁটানো পোস্টারগুলোর একটিতে লেখা রয়েছে- ‘ধর্ম, রাজনীতি ও বিবাহের আলাপ আমার রুমে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’।

তবে সেই ‘আলাপেই’ শেষ পর্যন্ত জেলে গেলেন হৃদয়; বিষয়টি এখনও মানতেই পারছে না পরিবার ও বন্ধুরা।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি ফারহানা মির্জা]

আরও পড়ুন