র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের উপর দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এখনই যে উঠছে না, তা স্পষ্ট হল যুক্তরাষ্ট্রের সফররত কর্মকর্তার বক্তব্যে।
Published : 20 Mar 2022, 05:17 PM
রোববার ঢাকায় দুই দেশের অংশীদারি সংলাপের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, এটা ‘জটিল ও কঠিন’ বিষয়।
এবারের সংলাপে আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে র্যাবের উপর ওয়াশিংটনের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমদসহ বাহিনীর সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, “এটা নিঃসন্দেহে আজকের আলোচনার জটিল ও কঠিন বিষয়। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে আমি বলতে পারি, আমাদের আলোচনার অনেক বিষয়ের মধ্যে এটা খুব কম সময়ই নিয়েছে।
“আপনারা জানেন, র্যাবের কার্যক্রম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি, গত তিন মাসে এসব বিষয় প্রতিকারের ক্ষেত্রে আমরা উন্নতি লক্ষ্য করেছি, যা পররাষ্ট্র সচিব মোমেন আজ খোলাসা করেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা সরকারের পরিকল্পনাসহ একটি প্রতিবেদন পেয়েছি এবং এসব বিষয়ে কাজ করতে চাই। কারণ নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।”
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মনে করি, বৈঠকে উভয়পক্ষ কিছু বিষয়ে একে অপরকে ভালোভাবে বোঝা এবং নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছে। যেমন- র্যাবের ও তার সংশ্লিষ্টদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমরা গভীর উদ্বেগ জানিয়েছি।
“আমরা এটা ব্যাখ্যা করেছি, কীভাবে এই নিষেধাজ্ঞা সরকারের সন্ত্রাসবাদ ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ মোকাবেলা কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগের বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়েছি। এক্ষেত্রে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চাই আমরা।”
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বলেন, “আমাদের আলোচনা হয়েছে। র্যাব ও এর কার্যক্রমের পাশাপাশি আমাদের নেওয়া কিছু উদ্যোগের বিষয় উল্লেখ করে আমরা একটি নন-পেপার ডোশিয়ার হস্তান্তর করেছি। তারা এটা নিয়ে যাবে এবং দেখবে।
“বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাব এবং আশা করি এই বিষয়টা সময়মত সমাধান হবে।”
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা রেখে দুদেশের সম্পর্ককে বিস্তৃত করা কীভাবে সম্ভব- এ প্রশ্নের উত্তরে নুল্যান্ড বলেন, “যখন মানবাধিকার ও মৌলিক আইনের লঙ্ঘন হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র কখনও চুপ করে থাকবে না।
“আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং আলোচনা অব্যাহত রাখব। কারণ আইনশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের অব্যাহত সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।”
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় রোববার বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
সামরিক সহযোগিতা চুক্তির খসড়া অনুমোদন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তির খসড়া নিয়ে সংলাপে মতৈক্য হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
তিনি বলেন, “জিসোমিয়া হচ্ছে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বেশি কিছু করার পথনকশা। আজ আমরা একটি খসড়া চুক্তি পাস করেছি এবং আমরা আত্মবিশ্বাসী, খুব দ্রুতই এটাকে চূড়ান্ত করতে পারব। যাতে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা একসাথে কাজ করতে পারি।”
দুইপক্ষের মধ্যে আদান-প্রদান করা সামরিক তথ্যের সুরক্ষা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য করা হয় জিসোমিয়া বা জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট।
চুক্তি খসড়া অনুমোদনের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে সংলাপে আলোচনা হওয়ার কথা জানান নুল্যান্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনীতির বিষয়ে আমাদের অবস্থান জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, “নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে আমাদের ইচ্ছার কথা বৈঠকে জানিয়েছি। আসন্ন নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা সংলাপে এ বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা হবে।”
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় রোববার বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
ইউক্রেইন-রাশিয়া প্রসঙ্গ
ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে ‘একযোগে’ কাজ করার প্রত্যাশার কথা সংলাপের সূচনা বক্তব্যেই জানান ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
তিনি বলেন, “বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে যখন গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইন হুমকির মুখে, তখন বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা একসাথে কাজ করতে চাই।”
বৈঠক শেষে শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে নুল্যান্ড বলেন, “ইউক্রেইনের কী হচ্ছে, বাংলাদেশ সব জানে এবং বোঝে। এটা বিনা প্ররোচনায় একটি গণতান্ত্রিক দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার উপর নিষ্ঠুর আক্রমণ, যাতে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে সমাধানের পথ রুদ্ধ করে যুদ্ধে জড়িয়েছে।
“এখন সব গণতান্ত্রিক দেশের একসাথে দাঁড়ানো দরকার। আমি আত্মবিশ্বাসী, সত্য বলতে এবং শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এই যুদ্ধ সমাপ্তির চেষ্টায় আমরাও একসাথে দাঁড়াব।”
তিনি বলেন, “বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আজকের সংলাপ এসেছে। ইউক্রেইন থেকে আসা বিভৎস চিত্র এবং রাশিয়ার অতর্কিত আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট আপনারা দেখতে পাচ্ছেন।
“যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের মিত্ররা রাশিয়াকে ইউক্রেইনের সাথে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য মাসের পর মাস চেষ্টা করেছে। মস্কো শোনেনি, বরং আক্রমণকে বেছে নিয়েছে।”
ইউক্রেইনে হামলার মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি ও জাতিসংঘ চার্টারের লংঘন হওয়ার বিষয়ে সংলাপে ভালো আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নুল্যান্ড বলেন, “এটা সব স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন মানুষের জন্য ইউক্রেইনের পাশে দাঁড়ানোর এবং যুদ্ধ বন্ধ হোক, বলার মুহূর্ত। এবং আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি।”
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় রোববার বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
বাইডেন প্রশাসনের সাথে সমন্বিত অংশীদারিত্বের আশা
যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার ইচ্ছার কথা জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
তিনি বরেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সহকর্মীদের বলেছি, সমন্বিত অংশীদারত্বের ক্ষেত্র তৈরিতে বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে উচ্চাশা রয়েছে বাংলাদেশের।
“একসাথে নিরাপত্তা ও প্রগতির যাত্রায় নিবিড়ভাবে কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ উৎসাহ নিয়ে থাকবে।”
নুল্যান্ড বলেন, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষার বিষয় দুটি পৃথক সংলাপের পাশাপাশি উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপও অনুষ্ঠিত হবে।
৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সাথে ওয়াশিংটনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সূচি রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি টিকফা’র পরবর্তী পর্ব চলতি বছর সই হওয়ার কথা রয়েছে।
দুইদেশের মধ্যে আসন্ন বৈঠকগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে সফররত নুল্যান্ড বলেন, এই বছর দুদেশের মধ্যে যে ‘ভোজ’ হবে, আজকের আলোচনা সেক্ষেত্রে ‘অ্যাপিটাইজার’ মাত্র।