‘অসত্য তথ্যে’ বাদ আমির হামজা: মোজাম্মেল

আবেদনে ‘অসত্য ও ভুল’ তথ্যের পাশাপাশি তথ্য ‘গোপন করায়’ দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা থেকে প্রয়াত আমির হামজাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2022, 03:06 PM
Updated : 18 March 2022, 06:51 PM

‘জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকা মোজাম্মেল হক শুক্রবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “অসত্য তথ্য, মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়েছে। অনেক তথ্য গোপন করে দিয়েছে, যখন আমাদের কাছে সাবমিট করেছেন।”

অবশ্য কী ধরনের ‘ভুল’ তথ্য দেওয়া বা ‘তথ্য গোপনের’ ঘটনা ঘটেছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত, সেসব বিষয় স্পষ্ট করেননি তিনি।

গত ১৫ মার্চ ২০২২ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ১০ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। নাগরিক মহলে অচেনা আমির হামজার নাম সাহিত্য ক্যাটাগরিতে দেখে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। পাশাপাশি এমন কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে, যাতে ওই পুরস্কারের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।

আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আমির হামজাকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি পর্যালোচনা করার কথা বলেছিলেন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, তারা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবেন। পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগও রয়েছে।

এরপর শুক্রবার বিকালে আমির হামজার নাম বাদ দিয়ে এবারের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ৯ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার দেওয়ার জন্য ‘স্বাধীনতা পুরস্কার সংক্রান্ত নির্দেশাবলী’ অনুসরণ করার কথা, যা সর্বশেষ ২০১৯ সালে সংশোধন করা হয়েছিল।

নির্দেশনা অনুযায়ী, ১২টি নির্ধারিত ক্ষেত্র থেকে মোট ১০টি পুরস্কার দেওয়ার কথা। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে পুরস্কারের সংখ্যা বাড়াতে বা কমাতে পারেন। আর পুরস্কারের ক্ষেত্র বাড়ানোরও সুযোগ আছে।

ওই ১২ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে- স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা/জনসেবা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জনপ্রশাসন এবং গবেষণা ও প্রশিক্ষণ।

চলতি বছরের প্রথম তালিকায় পাঁচ বিভাগে পুরস্কৃতের কথা জানানো হয়, যার মধ্যে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বিভাগে ছয়জনকে, চিকিৎসাবিদ্যায় দুইজনকে, স্থাপত্য ও সাহিত্যে একজন করে মনোনীত হন। আর একটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন দেওয়া হয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণ বিভাগে।

শুক্রবার নতুন তালিকায় তাদের সবার নাম থাকলেও সাহিত্যে প্রয়াত আমির হামজার নামটি শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে। ওই ক্যাটাগরিতে অন্য কারও নাম সেখানে দেওয়া হয়নি।

এর আগে ২০১৬ সালে সরকার স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ১৫ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করলে সেখানে নিজের নাম না দেখে ফেইসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। পরে তার নাম যুক্ত করে আলাদা আদেশ জারি হয়। ওই বছরই পদক নেন এই কবি।

যেভাবে দেওয়া হয় স্বাধীনতা পুরস্কার

২০১৯ সালে সংশোধিত স্বাধীনতা পুরস্কার সংক্রান্ত নির্দেশাবলীতে বলা হয়েছে, “স্বাধীনতা পুরস্কার দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বিধায় এই পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রার্থী নির্বাচনকালে দেশ ও মানুষের কল্যাণে অসাধারণ অবদান রাখিয়াছেন, এমন সীমিত সংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেই বিবেচনা করা হইবে।”

নির্দেশাবলীতে রয়েছে, পুরস্কারের সংখ্যা সাধারণভাবে কোনো বছর ১০টির বেশি হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে সংখ্যা বাড়ানো কিংবা কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

পুরস্কারের পদ্ধতি বর্ণনা করে নির্দেশাবলিতে বলা হয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে পরবর্তী বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব আহ্বান করে সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগে এবং এর আগে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার বা স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাছে চিঠি পাঠাবে।

“মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ নিজ নিজ কার্যসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পুরস্কারের জন্য এবং ইতঃপূর্বে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার বা স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তগণ নির্ধারিত যে যে কোনো ক্ষেত্রে পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করিতে পারিবে/পারিবেন।”

এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে পাওয়া নামের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করবে ‘প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি’। যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রস্তাব জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করা হয়।

নির্দেশিকায় বলা হয়, মন্ত্রণালয় বা বিভাগের থেকে প্রস্তাবের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব প্রস্তাবে স্বাক্ষর করবেন।

এ বছর আমির হামজার নাম সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করেছেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, যা তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বীকার করেছেন।

বাণিজ্য সচিব প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সদস্য এবং জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে ‘সহায়তাদানকারী’ কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত।

কে এই আমির হামজা?

আমির হামজার বিষয়ে খবর নিয়ে ‘বাঘের থাবা’, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ ও ‘একুশের পাঁচালি’ নামে তার তিনটি বইয়ের হদিস পাওয়া যায়। জন্মস্থান মাগুরায় তাকে ‘চারণ কবি’ হিসেবে চিনতেন অনেকে। কেননা তিনি গানের আসরে বসে গান লিখতেন, সুর করতেন।

‘১৯৭০ সালের’ নির্বাচনে আমির হামজা আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন বলে স্থানীয়দের কথায় উঠে আসে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১৯৭৮ সালে একটি খুনের মামলার প্রধান আসামি ছিলেন আমির হামজা। বিচারিক আদালতের রায়ে ওই মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হলেও পরে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ সাধারণ ক্ষমা পান তিনি।

আমির হামজার ছেলে আছাদুজ্জামান সরকারি কর্মকর্তা। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন তিনি।

২০১৯ সালে মারা যাওয়া আমির হামজাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা ছেলের তৎপরতার কথাও আসে সংবাদ মাধ্যমে।

মন্ত্রী মোজাম্মেল শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা তথ্য গোপন করেছে, ভুল তথ্য, অসত্য দিয়েছে, সে ব্যাপারেও আমরা দেখব ইনশাআল্লাহ।”

আমির হামজার আগে ২০২০ সালে সাহিত্যে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা রইজ উদ্দিনের নাম ঘোষণা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল সাহিত্যিকদের মধ্যে।

সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন জনের সমালোচনা ও ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি টেলিভিশন টক শোর আলোচনার বিষয়বস্তুও হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

সমালোচনার মুখে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে রইজকে বাদ দিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তখন রইজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “কেন দিল, কেনই বা কেড়ে নিল!”