‘আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জ’ নতুন ইসির সামনে

‘দ্বন্দ্ব’ সামলে সব দলকে নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকেরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2022, 07:21 PM
Updated : 26 Feb 2022, 07:21 PM

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যাদের অধীনে হবে, নবগঠিত সেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দিকেই এখন সবার নজর।

সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া তিনজন সাবেক আমলা, একজন সাবেক বিচারক ও একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে ত্রয়োদশ ইসি গঠন করা হয়েছে শনিবার।

আগের ‘বির্তক’ ও অনেক ক্ষেত্রে ‘আস্থাহীনতাকে’ পেছনে ফেলে নবগঠিত কমিশনের এগিয়ে চলার বিষয়ে নতুন সিইসি আবদুল আউয়াল নিজে যেমন কথা বলেছেন, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

নতুন সিইসি আবদুল আউয়াল সব দলকে নিয়েই নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশার কথা বলেছেন। বলেছেন সব দলের প্রতি ‘সমান আচরণ’ নিশ্চিত করতে তিনি কাজ করবেন।

তবে আগের ইতিহাস বলছে কাজটি খুব সহজ হবার নয়। বিষয়টি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলেছে দুই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকের সঙ্গে।

এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের অধীনে সাবেক তত্ত্বাধায়ক সরকারের সময়ে নবম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় রয়েছে দলটি।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নবম সংসদে অংশ নিলেও ২০১৪ কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনে আসেনি তারা।

পরে কে এম নূরুল হুদার কমিশন নানা নাটকীয়তার মধ্যে বিএনপিসহ অধিকাংশ দলকে ২০১৮ সালের ভোটে আনতে পারলেও সমালোচনা তাদের পিছু ছাড়েনি।

এবার সার্চ কমিটি গঠনে সংলাপ, আইন প্রণয়ন ও সার্চ কমিটি গঠন থেকে শুরু করে নতুন ইসি নিয়ে বরাবরই অনাগ্রহ দেখিয়েছে বিএনপি।

আর আওয়ামী লীগ ও দলটি মিত্ররা নতুন কমিশনকে স্বাগত জানিয়ে আগামী নির্বাচনে তারা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশনকেও ‘বাড়তি চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম।

তিনি বলেন, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মানুষের মধ্যে কিছু ‘বির্তক’ রয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর প্রথম আইনের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি করে দিলেও রাজনৈতিক দলসহ সবার আস্থা কুড়ানোই হবে একটা চ্যালেঞ্জ।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সাবেক আমলা, বিচারক ও সেনা কর্মকর্তাদের দিয়ে গঠিত এ কমিশন ‘ভালো’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিশ্লেষক বলেন, “এখন নতুন ইসির সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাজ দেখিয়ে আস্থা অর্জন করা। সব মহলের আস্থা অর্জন করতে হবে, সহিংসতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কমিশনে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে।”

আব্দুল আলীম বলেন, নির্বাচনে আনতে নতুন সিইসির কাজ হবে দলসহ সবার সঙ্গে বারবার সংলাপের আয়োজন করা। সেই সঙ্গে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ যেসব স্থানীয় নির্বাচন রয়েছে সেগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমন কাজ করা।

নির্বাচন পযবেক্ষক সংস্থাগুলোর গ্রুপ ইলেকশন ওয়ারর্কিং গ্রুপের সাবেক এ নির্বাহী পরিচালক জানান, ইভিএমে ভোট বড় পরিসরে করতে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে ভালোভাবে নির্বাচন করতে পারলে ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে সমালোচনা হয়ত কোনো পক্ষ থেকে আসবে না বলে মনে করেন তিনি।

পাশাপাশি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই বছর মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

“প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে-ট্রাস্ট বিল্ডিং। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে অংশীজন রয়েছে, রাজনৈতিক দল, জনগণ, নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক সংস্থা-এদের প্রত্যেকের আস্থা অর্জন করা। এ আস্থা অর্জন করা হবে খুবই চ্যালেঞ্জিং। নতুন কমিশনের স্বচ্ছতার সঙ্গে ওপেন হয়ে কাজ করা দরকার, যাতে করে এ আস্থা আসে; সবার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।”

সবশেষ নির্বাচন কমিশনে সিইসি ও একজন নির্বাচন কমিশনারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে রূপ নেওয়ার পর সব মহলে আলোচনার ঝড় উঠে। ভিন্নমত থাকলেও তা প্রকাশ্য রূপ নেওয়ায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের আস্থা সংকটের মধ্যে পড়ে।

আব্দুল আলীম বলেন, “কমিশন একটা কম্পোজিট বডি। এখানে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। নিজেদের মধ্যে আস্থা সংকট থাকলে মানুষের আস্থা অর্জন করা দূরুহ হবে।”

এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জানান, ভোটে সহিংসতা রোধেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

“সহিংসতা হলে দেখলাম দায় কেউ নেয় না। তাহলে এটা কার দায়। এটাকে সামহাউ এড্রেস করতে হবে। সহিংসতা হলে ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন না। টার্ন আউট কমে যাবে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যাবে। কেউ ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায় না। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।”

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা- জানিপপ এর চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করাই হবে নতুন ইসির চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, “স্বাগত ও শুভকামনা জানাচ্ছি। আশা করি, তারা রক্ষণশীল থাকবেন। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ করা হবে তাদের চ্যালেঞ্জ। এখন দ্বিমুখী বাস্তবতার মধ্যে নতুন ইসিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে। দেখা যাক, পরিস্থিতিতে তারা কী রকম করে।”

সোনারগাঁও উপজেলার ধামগড় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কাজীপাড়া এলাকা ছেয়ে গেছে পোস্টারে। এই ইউনিয়নে ভোট হবে আগামী ১১ নভেম্বর। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

নতুন সিইসি হাবিবুল আউয়াল আস্থা ফেরানোর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।

নিয়োগের প্রজ্ঞাপনের পর সাংবাদিকরা তার ইস্কাটনের বাসায় যান। সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সব দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করতে কাজ করার কথা জানিয়েছেন।

তবে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব দায় শুধু নির্বাচন কমিশনের ওপর দেওয়া যাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা না পান তবে তাকে নিয়েও ‘ইমেজ সংকট’ হতে পারে।

আস্থার পরিবেশ তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের মুখ্য ভূমিকা আছে, সেখানে ভূমিকা কী থাকবে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি মনে করি না সব আমার দায়িত্ব। এখানে অন্যদের ভূমিকা আছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে। আমি যদি ভুল করি সমালোচনা করবেন। ধরিয়ে দেবেন। চ্যালেঞ্জ বলে পিছিয়ে যাব না। মোকাবেলা করতে হবে। সেটা করব।

“আমি সবাইকে বলব, নির্বাচনে আসুন। মাঠ ছেড়ে যাবেন না। রাজনৈতিক দল মানেই নির্বাচন করবে। তাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। যারা বলছেন নির্বাচন করবেন না। তাদের প্রতি অবশ্যই আহ্বান থাকবে, আসেন, নির্বাচন করেন। না হলে ডেমোক্রেসি শক্তিশালী হবে না।”

আওয়ামী লীগ বলছে ‘প্রত্যাশা পূরণ হবে’, ‘আগ্রহ নেই’ বিএনপির

নতুন ইসিকে স্বাগত জানিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় ‘দেশবাসীর প্রত্যাশা’ পূরণ হওয়ার বিষয়ে আশা প্রকাশ করেছেন।

তারা বলছেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন নতুন ইসি উপহার দিতে পারবে।

আওয়ামী লীগ নতুন ইসিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে জানিয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, "নতুন নির্বাচন কমিশনার একজন ভালো মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। তার দায়িত্ব হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা।“

দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

“বাংলাদেশের মানুষ যাতে ভোটের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে সেই বিষয় নিশ্চিত করবে এই কমিশন।”

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, "ইসি নিয়ে যাতে কোনো বিতর্ক না হয় আমার মনে হয় সেটা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য এ কমিশনকে নিয়ে অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে বিতর্কিত করার চেষ্টা না করা হয়, সেটাই জাতির প্রত্যাশা।"

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার নতুন ইসিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, তারা নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখবে।

অপরদিকে বিএনপি আগের মতোই ইসি নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “নতুন সিইসি বা কমিশনার কারা হলেন এটা নিয়ে আমাদের কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আমাদের কোনো আগ্রহই নেই। এটা নিয়ে আমরা কোনো কথাই বলতে চাই না।

“আমাদের মূল কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।”

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন ‘তাদের আজ্ঞাবহ’ হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, “তাদের অনুগত হয়ে কাজ করে। তাই সরকারে আওয়ামী লীগ থাকলে সেখানে নির্বাচন কোনোভাবেই নিরপেক্ষ হবে না-এটাই ইউনির্ভাসাল ট্রুথ।”