‘ইউক্রেইন থেকে আমাদের বের করুন’, আকুতি বাংলাদেশি যুবকের

দামামা বাজছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বাঁধবে না, এই আশায় ইউক্রেইনে থেকে গিয়েছিলেন যেসব বাংলাদেশি, তারা এখন পড়েছেন বড় বিপদে।

শামীমা নাসরিন লাকীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2022, 11:30 AM
Updated : 24 Feb 2022, 03:04 PM

বৃহস্পতিবার রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করে দেওয়ার পর দেশে স্বজনরা ফিরে আসার পরামর্শ দিলেও কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের দেশটি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় পাচ্ছেন না তারা।

ইউক্রেইনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই যে প্রবাসীরা সাহায্যের জন্য সেখানে যেতে পারবে। পাশের দেশ পোল্যান্ডের দূতাবাস থেকে অবশ্য যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

“সেখান (পোল্যান্ড দূতাবাস ) থেকে আমাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে দেশে ফিরব?” বলেন আটকে পড়া বাংলাদেশি আহমেদ ফাতেমী রুমি।

ইউক্রেইনে খুব বেশি বাংলাদেশি নেই। হাজার খানেক হতে পারে বলে ধারণা দেন দুই মাস আগে শিক্ষার্থী ভিসায় দেশটিতে যাওয়া সিলেটের রুমি।

ইউক্রেইনে রুশ সেনা অভিযান শুরুর পর বৃহস্পতিবার সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে রুমনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

এই যুবক বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে পরিবার থেকে তাকে বার বার ফোন করে ফিরে যেতে বলা হচ্ছে।

“আমি তাদের বলেছি, এখানে সব ঠিক আছে। যাতে তারা আতঙ্কিত হয়ে না পড়ে,’ স্বজনদের শান্ত রাখতে একথা বললেও রুমন নিজেই দেখছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই।

রুমন থাকেন ইউক্রেইনের মারিওপোল শহরে। আজভ সাগরের তীরবর্তী এই শহরটি দোনেৎস্ক অঞ্চলে অবস্থিত। ইউক্রেইনের রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে দুটি অঞ্চল দখল করে আছে দোনে‍ৎস্ক তার একটি, অন্যটি লুহানস্ক।

রাশিয়া সীমান্তবর্তী এই দুই অঞ্চলে ট্যাংক নিয়ে রুশ সৈন্যরা ঢুকে পড়লেও মারিয়াপোল বৃহস্পতিবারও ইউক্রেইন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল।

কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেইনে রাশিয়া আগ্রাসন চালাতে পারে বলে জোর আলোচনা চলছিল। গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি বলছিল, যে কোনো সময় রাশিয়া ইউক্রেইনে হামলা চলাবে।

এরপরও কেন তিনি শহর ছাড়লেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে রুমি বলেন, “গতকালও শহরের পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হবে না। সব কিছু মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। তাই আমিও শহর ছাড়ার চিন্তা করিনি।”

তবে একটি ছাত্রাবাসে থাকা রুমন বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি ত্বরিত বদলে যেতে দেখেন। স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে বিকট শব্দে তার ঘুম ভাঙে। তার পরপরই আরও কয়েকটি বিকট আওয়াজ শুনতে পান তিনি।

মারিওপোলের অবস্থা বর্ণনা করে এই বাংলাদেশি বলেন, “শহরের ভেতর ট্যাক্সি, বাস এখনও চলছে, তবে সংখ্যা কমে গেছে। অন্য শহরে যাওয়ার সব যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

“মানুষজনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। প্রচুর মানুষ নানাভাবে শহর ছাড়ার চেষ্টা করছেন। রাস্তায় ইউক্রেইনের সেনাদের চেকপোস্ট আমি দেখেছি। সম্ভবত শহরে যেন বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে না পড়ে, তাই এই ব্যবস্থা। কারণ, এই শহরে রুশপন্থিরাই বেশি। তবে চেকপোস্টের সেনারা এমনিতে কাউকে কিছু বলছে না বা বাধা দিচ্ছে না।”

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, জীবন বাঁচাতে অনেকে খাবার মজুদ করছে। আপনিও এমন কিছু করেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে সুপারশপে খাবার আছে। লোকজন একটু বেশি কেনাকাটা করছে। তবে খুব হুড়োহুড়ি এখনও টের পাচ্ছি না।

“তবে অর্থ তোলার জন্য লোকজন এটিএম বুথের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। চার পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর তবেই টাকা তোলা যাচ্ছে। এক একটা লাইন আধা কিলোমিটারের বেশি লম্বা।

“যদিও আমি টাকা তুলতে যাইনি। তবে শুনেছি, মেশিনে টাকা আছে এবং সবাই প্রয়োজনমতো তুলতে পারছে। এটিএমে টাকা ফুরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে রিফান্ড করা হচ্ছে।”

বৃহস্পতিবার সকালে ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ার গোলা এসে পড়ে। ছবি: মাহবুব পারভেজ

ইউক্রেইনে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকলেও অনারারি কনস্যুলেটর রয়েছেন। যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টির পর পোল্যান্ডে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে ইউক্রেইনে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে জানান রুমন।

তিনি বলেন, “পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা ম্যাডাম (সুলতানা লায়লা হোসেন) আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। গতকালও জুমে আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন।

“সেখান থেকে আমাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে দেশে ফিরব? আমার সঙ্গে বাংলাদেশের আরও কয়েকজন স্টুডেন্ট আছে।”

যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেইন ছাড়ার চেষ্টা চালিয়েও বিফল হয়েছেন রুমি। 

“শহর ছাড়ার জন্য সকালে আমি প্রথমে অনলাইনে টিকিট কেনার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হয়ে সারাদিনে বেশ কয়েকবার বাস স্টেশন এবং রেল স্টেশনে ছোটছুটি করেছি। কিন্তু কোথাও টিকেট পাইনি।”

বাংলাদেশি এই যুবক বলেন, “আমি যেভাবে হোক একটি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে চাই।

“আপনাদের মাধ্যমে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করছি, তিনি যেন আমাদের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা করেন। আপাতত তিনি যেন আমাদের নিরাপদ কোথাও সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। সেটা হতে পারে পোল্যান্ড, হতে পারে রোমানিয়া বা অন্য কোনো নিরাপদ জায়গা।”

“ইউক্রেইনে খুব বেশি বাংলাদেশি নেই। বড়জোর ৫০০ থেকে একহাজার জন হবে। তাদের যাকে সেখানে সম্ভব সরিয়ে নিন। দয়া করে আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করুন। তারপর না হয় দেশে ফেরা বা যা সিদ্ধান্ত হয় নেবেন। আপাতত আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন,” বলেন তিনি।

এদিকে নয় বছর ধরে ইউক্রেইনে বসবাসরত গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার মাহবুব পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পোল্যান্ডে বাংলাদেশের দূতাবাসের হিসাবে ইউক্রেইনে দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন। তবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সেখানে বাংলাদেশির সংখ্যা এর চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। 

তিনি জানান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক সময় বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অনিবন্ধিত অভিবাসীদের কিছু সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে ইউক্রেইনে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কর্মতৎপরতা ‘চোখে পড়ার মতো নয়’।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ইউক্রেইনের সঙ্গে থাকা নিজেদের সীমান্ত পোল্যান্ড খুলে দেবে বলে খবর পেয়েছেন পারভেজ।

তিনি বলেন, “ইউক্রেইনে আটকে পড়া তৃতীয় কোনো দেশের নাগরিক যদি পোল্যান্ডে যেতে চান, তাহলে ১৫ দিনের ট্রানজিটে তিনি সেদেশে থাকার অনুমতি পাবেন। দূতাবাস আমাদেরকে পোল্যান্ডের ট্রানজিট ভিসাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি এ মুহূর্তে নিজ দেশে ফেরত যেতে চান, তাহলে তাকে সরাসরি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।”