ঘুষ লেনদেন: ডিআইজি মিজানের ৩ বছর সাজা, দুদকের বাছিরের ৮ বছর

একজন ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্তা, আরেকজন দুর্নীতি দমনের যোদ্ধা। ৪০ লাখ টাকার ঘুষের লেনদেনে জড়িয়ে এখন তাদের দুজনকেই জেল খাটতে হবে।  

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2022, 06:50 AM
Updated : 23 Feb 2022, 04:32 PM

এর মধ্যে পুলিশের বরখাস্ত উপ-মহাপরিদর্শক মিজানুর রহমানকে দণ্ডবিধির ১৬৫ এ ধারায় ৩ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

আর দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে দণ্ডবিধির ১৬১ ধারায় ৩ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি মুদ্রা পাচার আইনে ৫ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড, ৮০ লাখ জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।

তবে দুই ধারার সাজা একসঙ্গে কার্যকর হবে বলে বাছিরকে সব মিলিয়ে ৫ বছর জেলে থাকতে হবে। দুজনের ক্ষেত্রেই হাজতবাসের সময় বাদ যাবে।

ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম বুধবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

এর আগে মিজানকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এবং বাছিরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আদালতে হাজির করা হয়। বেলা ১১টার পর তাদের তোলা হয় কাঠগড়ায়।

ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে এ মামলায় দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইন, অর্থপাচার এবং দণ্ডবিধির আওতায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল দুদক। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ৩ ফেব্রুয়ারি মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

বাছিরের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান। আর মিজানুরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মিজান ও বাছির দুজনেই উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

তিন বছরের দণ্ড হলেও মিজান ছিলেন উৎফুল্ল। সাংবাদিকদের সামনে দুই আঙুলে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে তিনি বলেছেন, দুদকে ‘এরকম আরও বাছির’ আছে। তবে বাছির ছিলেন অনেকটাই নির্বিকার।

বাছির ২০২০ সালের ২২ জুলাই গ্রেপ্তারের পর থেকে ১ বছর ৭ মাস ধরে কারা অন্তরীণ রয়েছেন। আর মিজানকে ২০২০ সালেই  সম্পদের মামলা থেকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

সাজা থেকে হাজতবাস বাদ যাবে বলে শিগগিরই তার মুক্তির সুযোগ মিলতে পারে, যদি অন্য মামলায় তিনি জামিন পেয়ে যান। আর বাছিরকে দু্ই ধারা মিলিয়ে সব মিলিয়ে ৫ বছর জেলে থাকতে হবে। তবে জরিমানার ৮০ লাখ টাকা দিতে না পারলে তার কারাবাসের মেয়াদ আরো ৬ মাস বাড়বে।

বিচারের কাঠগড়ায় যেভাবে

এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ওঠায় ২০১৯ সালে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মিজানকে।

এর চার মাস পর তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক; এক হাত ঘুরে সেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান কমিশনের তৎকালীন পরিচালক এনামুল বাছির।

সেই অনুসন্ধান চলার মধ্যেই ডিআইজি মিজান দাবি করেন, তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা বাছির।

এর পক্ষে তাদের কথপোকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ একটি টেলিভিশনকে দেন তিনি। ওই অডিও প্রচার হওয়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা।

অভিযোগটি অস্বীকার করে বাছির দাবি তখন করেন, তার কণ্ঠ নকল করে ডিআইজি মিজান কিছু ‘বানোয়াট’ রেকর্ড একটি টেলিভিশনকে সরবরাহ করেছেন।

অন্যদিকে ডিআইজি মিজান বলেন, সব জেনেশুনেই তিনি কাজটি করেছেন ‘বাধ্য হয়ে’।

এরপর ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থার পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে তিনি অভিযোগপত্র দেন।

‘অবৈধভাবে সুযোগ প্রদানের হীন উদ্দেশ্যে’ এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয় অভিযোপত্রে।

ঘুষের অভিযোগ ওঠার পর তাদের দুজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। ২০২০ বছরের ২২ জুলাই এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার করে দুদকের একটি দল। আরেক মামলায় গ্রেপ্তার ডিআইজি মিজানকেও পরে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গত বছর ১৮ মার্চ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ হয়। এরপর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

গত ২৩ ডিসেম্বর মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। মামলায় চার্জশিটভুক্ত ১৭ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত।

এই সাক্ষীরা হলেন, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদক পরিচালক. শেখ মো. ফানাফিল্যা, দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ, দুদকের প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান সহকারী এস এম আবু জাফর বিশ্বাস, দুদক প্রধান কাযালয়ের প্রশিক্ষণ শাখার কনস্টেবল মো. অলিউজ্জামান শেখ, দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখার উচ্চমান সহকারী মো. জিল্লুর রহমান, দুদকের মানব সম্পদ বিভাগের সহকারী পরিচালক আজিজুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম নাজেম আহমেদ, মেজর নাহিদ আল আমিন, কমান্ডার এম মোতাহার হোসেন, মেজর ফাহিহম আদনান সিদ্দিকী, বরগুনার বেতাগি থানার কদমতলা গ্রামের মো. নাছির উদ্দিন বাবু, বরিশাল, ডিআইজি মিজানের অর্ডারলি কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেন, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার রুহুল্লি গামের বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত গাড়িচালক এস এম এনামুল হক, বরিশালের মূলাদির কাজিরচরের হৃদয় হাসানি এবং মিজানের স্ত্রীর দোকানের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম।

যুক্তিতর্ক শুনানির আগে ৩ জানুয়ারি আত্মপক্ষ শুনানিতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন মিজানুর রহমান ও এনামুল বাছির। পরে ১২ জানুয়ারি মিজান ৬ পৃষ্ঠার এবং এনামুল বাছির ১২ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দেন।

কী বলেছিলেন সাক্ষীরা?

গতবছর ২৬ সেপ্টেম্বরে আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ডিআইজি মিজানের উত্তরার বাসা থেকে তিনি দুটি ব্যাগ (একটি বাজারের ব্যাগ) গাড়িতে তুলে দেন। ব্যাগে ২৫ লাখ টাকা এবং কিছু বই ছিল।

ডিআইজি মিজান পরে সাদ্দাম হোসেনকে রাজারবাগে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তোলেন। কিন্তু সাদ্দামকে তিনি রমনা পার্কের সামনে নিয়ে যান এবং বলেন তার সাথে কথা বলার জন্য একজন লোক আসবে।

সাদ্দাম আদালতকে বলেছেন, কিছুক্ষণ পরে এক লোক রমনা পার্কে আসেন এবং মিজানের সঙ্গে পার্কের ভেতরে গিয়ে কথা বলেন। পরে তারা গাড়িতে ওঠেন। ডিআইজি মিজান গাড়ির চালককে বলেন, কথা বলতে আসা সেই লোককে যেন রাজারবাগ মোড়ের সামনে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গলিতে নামিয়ে দেওয়া হয়।

“যাতায়াতের মধ্যবর্তী সময়ে তারা অনেক কথা বলেন। মিজান স্যার ওই লোককে বলেন, ব্যাগে ২৫ লাখ ঠিক আছে। তখন ওই লোক প্রশ্ন করেন যে ‘সব ঠিক আছে ভাই?’ মিজান স্যার বলেন, সব ঠিক আছে। পরে ওই লোকটাকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গলিতে নামিয়ে দেওয়া হয়।”

সাদ্দাম বলেছেন, লোকটি নেমে যাওয়ার পর ডিআইজি মিজানের কাছে তার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন তিনি। তখন ডিআইজি মিজান তাকে বলেছিলেন, লোকটি দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছির।

এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি মিজানের বাসা থেকে একটি শপিং ব্যাগ এবং একটি হ্যান্ড বল গাড়িতে তুলে দেওয়ার কথাও আদালতে বলেছেন সাদ্দাম। তার দাবি অনুযায়ী সেদিন ব্যাগে ছিল ১৫ লাখ টাকা।

সাক্ষ্যে বলা হয়, তারা সেদিনও রমনা পার্কের সামনে যান। এনামুল বাছির পার্কের সামনে এলে তার সঙ্গে মিজান ভেতরে যান। কথা শেষে তারা আবার গাড়িতে ওঠেন। এনামুল বাছিরকে শান্তিনগর মোড়ে নামিয়ে দিতে বলেন ডিআইজি মিজান। সেদিনও গাড়িতে তারা কথা বলেন।

সাদ্দামের ভাষ্য অনুযায়ী, এনামুল বাছির সেদিন ডিআইজি মিজানকে বলেন, তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় ‘কিছু নেই’। তার কিছু হবে না। গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় এনামুল বাছির টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে যান।

ডিআইজি মিজান ২০১৯ সালের ৩০ মে গুলশান পুলিশ প্লাজায় যান এবং এনামুল বাছির সেখানে আসেন। তারা সেখানেও কথা বলেন।

সাদ্দাম সাক্ষ্যে বলেছেন, এনামুল বাছির সেদিনও ডিআইজি মিজানকে বলেন, ওই মামলায় কোনো ‘কাগজপত্র নেই’। তার কিছু ‘হবে না’।

মিজানের স্ত্রীর দোকানের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।

গুলশান পুলিশ প্লাজায় এনামুল বাছিরের সঙ্গে মিজানের এক সাক্ষাতের ঘটনা তুলে ধরে রফিকুল আদালতে বলেন, “মিজান স্যার উনাকে বলেন, টাকা দিলাম, তারপরও আমার নামে কেস হল। এই কথোপকথনের পর তারা বের হয়ে যান।”

পুরনো খবর