‘আপস’ করলে এতকিছু হত না, দাবি চাকরিচ্যুত শরীফের

দুদকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন দাবি করেছেন, যাদের বিরুদ্ধে তিনি মামলার সুপারিশ করেছেন, তাদের অভিযোগেই তাকে কমিশন থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে যাচাই-বাছাই না করে; অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ‘আপস’ করলে এতকিছু ‘হত না’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2022, 03:55 PM
Updated : 21 Feb 2022, 03:55 PM

তাকে চাকরি থেকে অপসারণের বিষয়ে দুদক সচিব সংবাদ সম্মেলন করে যেসব ‘কারণ’ তুলে ধরেছেন, সেসব বিষয়ে এক লিখিত ব্যাখ্যায় এ দাবি করেছেন শরীফ।

‘শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে’ উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে বিধি অনুযায়ী চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন।

‘পাঁচ পৃষ্ঠার’ লিখিত বক্তব্যে কমিশনের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, শরীফের বিরুদ্ধে ‘শৃঙ্খলা বহির্ভূত’ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও দপ্তর থেকে আসা নানা অভিযোগের কথা বলেন।

এসব ‘যুক্তি খণ্ডন’ করে সোমবার সংবাদমাধ্যমে ১৪ পৃষ্ঠার একটি লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন শরীফ উদ্দিন।

সেখানে তিনি বলেছেন, “আমার বিরুদ্ধে চলমান সবগুলো অভিযোগের অভিযোগকারীরা হলেন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ। যারা অভিযোগ করেছেন তারা সবাই আমার অনুসন্ধান/মামলা সংশ্লিষ্ট, তারা তো অভিযোগ করবেই। এই রকম হলে সংক্ষুব্ধদের বিপক্ষে গেলে দুদকের অনেকেরই চাকরি যাবে। কারণ তারা তো এইটাতে মোটিভিটেড হবে।”

এসব অভিযোগ কমিশন আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করেছে দাবি করে শরীফ বলেন, “অভিযোগ প্রমাণের আগেই কারণ দর্শানো নোটিস ছাড়াই সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকাবস্থায়ই চাকরি হতে অপসারণ করেন, এটা সাংবিধানিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা হল।”

তার ভাষ্য, “আমি অধিকাংশ নথিরই মামলার সুপারিশ করতাম। যদি আপস হতাম, তাহলে এগুলো কিছুই হতো না।”

দুদক সচিবের অভিযোগ, শরীফ কোনো অনুসন্ধান বা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া মাত্র দুদকের নির্দেশিকা অনুসরণ না করে ‘নিজের খেয়ালখুশি মত’ কাজ করতেন।

এ বিষয়ে শরীফ বলেন, “অনুসন্ধান/তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পরে নির্দেশিকা অনুসরণ না করে খেয়ালখুশি মত অনুসন্ধান/তদন্তের অভিযোগটি সুনির্দিষ্ট নয়। সজেকার (সমন্বিত জেলা কার্যালয়) দায়িত্বে ডিডি থাকেন। কাউকে তলব করলে নোটিসের একটি কপি ডিডিকে প্রদান করা হয়। অভিযোগটি সত্য নহে।”

অনুসন্ধান বা তদন্ত করার সময় অভিযোগের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, এরকম বহু ব্যক্তিকে নোটিস বা টেলিফোনের মাধ্যমে ডেকে এনে শরীফ ‘হয়রানি’ করতেন বলেও কমিশনের অভিযোগ।

এ বিষয়ে অপসারিত দুদক কর্মকর্তার ভাষ্য, “অনুসন্ধান/তদন্তকালীন কাউকে ডেকে এনে হয়রানি করা হত, তা সঠিক নয়, বিষয়টি সুনির্দিষ্টকরণ করা চাই। প্রমাণ উপস্থাপনের দাবি জানাচ্ছি। চট্টগ্রাম-২ এ কর্মকালীন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বেলায়েত হোসেনের এমন অভিযোগ করেছিলেন, তাতে আমার পক্ষে রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। অভিযোগটি সত্য নহে।”

অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ বা নো ডেবিট’ করার প্রয়োজন হলে ‘আইন মানতেন না এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতেন না’ বলে যে অভিযোগ, সে বিষয়ে শরীফ বলেন, “অভিযুক্ত বেলায়েত হোসেনের ৫০ লাখ টাকা সরল বিশ্বাসে নো ডেবিট করা হয়েছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে তা করা হয়নি। তদন্তের স্বার্থে ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে, আদেশ প্রদান করা হয়নি।”

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামির জবানবন্দি ও গোপন তথ্য জেনে ওই ‘অবৈধ ও ঘুষের টাকা’ ব্যাংক থেকে ‘দ্রুত উত্তোলন করার’ সম্ভাবনা থাকায় ‘কমিশন ও দেশের স্বার্থে’ তা করা হয়েছিল বলে দাবি শরীফের।

“হিসাবগুলো সন্দেহমুক্ত হয়, সেগুলোতে চিঠি দিয়ে কিছু কিছু ব্যাংককে নো ডেবিট চিঠি প্রত্যাহার করে নিই। যার বিবরণ প্রতিবেদনে রয়েছে। তবে আমার উচিৎ ছিলো কমিশনের অনুমোদনক্রমে আদালতের আদেশ নিয়ে অপরাধলব্ধ টাকা জব্দ করা। এটা ছিলো প্রসিডিউর। আসলে অপরাধলব্ধ টাকাগুলো যেন দ্রুত স্থানান্তর/উত্তোলন করতে না পারেন, সেজন্য তদন্তের স্বার্থেই সাময়িক সময়ের জন্য টাকা উত্তোলন বন্ধ করে দিই।”

কক্সবাজারে একজন সার্ভেয়ারের কাছ থেকে ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা জব্দ করে তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে এক বছর ৪ মাস শরীফ নিজের হেফাজতে রাখেন বলে রোববারের সংবাদ সম্মেলেনে তথ্য দেন দুদক সচিব।

এ বিষয়ে শরীফ বলেন, “এই টাকা জব্দ করে র‌্যাব। জব্দকৃত আলামতের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা গ্রহণ করার পর সেগুলো কোষাগারে জমা রাখা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। সরকারি ট্রেজারি বা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখতে গেলে জানা যায়, আলামতের টাকাগুলো কাপড় মুড়িয়ে ট্রাংক বা বাক্সে ভরে জমা দিতে। সেক্ষেত্রে জমা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ একটি বাক্স বা ট্রাঙ্ক ‘বুঝে পেলাম’ মর্মে গ্রহণ করবেন। বাক্স বা ট্রাঙ্কের ভেতর কী কী আছে, বা কি পরিমাণ আছে, সেটা উল্লেখ করেন না। এটাই নাকি তাদের নিয়ম।”

আলামতের টাকা এভাবে প্রমাণ-রেকর্ড ছাড়া জমা রাখার ‘পক্ষপাতী ছিলেন না’ দাবি করে চাকরিচ্যুত এই কর্মকর্তা বলেন, “অন্য একটি অপশন বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিল, যা তাদের বিবিধ হিসাব খাতে জমা করা হত এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সে জব্দকৃত আলামতের টাকা বাজারে সার্কুলেট করে দিত। সেক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়ায় সময় জব্দকৃত টাকা আদালতে দেখানো সম্ভব হত না। মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হত। আসামিরা বেনিফিট পেত।”

জব্দ করা আলামতের টাকা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে রাখার ‘অসংখ্য নজির’ কমিশনে রয়েছে বলে দাবি করেন শরীফ।

‘প্রভাব খাটিয়ে’ ভাই ও আত্মীয়কে চাকরি দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ তুলেছে দুদক, তা ‘সত্য নয়’ বলে তিনি দাবি করেন।

শরীফের ভাষ্য, তার ছোট ভাইসহ এলাকার শিক্ষিত অনেক বেকারই ২০১৭ সাল থেকে দুই বছরের চুক্তিতে আউটসোর্সিংয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে কেজিডিসিএলে চাকরি করেছেন। তখন কেজিডিসিএলের এমডি ছিলেন খায়েজ আহম্মদ মজুমদার।

এছাড়া যে আত্মীয়কে চাকরি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাকে ‘চেনেন না’ বলেও তিনি দাবি করেছেন।

চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে পটুয়াখালীতে যাওয়ার পর ‘চাঁদাবাজি’ করেছেন বলে যে অভিযোগ এসেছে, সে বিষয়ে শরীফ বলেন, “পটুয়াখালীতে আমার কোনো নথিই ছিল না। সেখান হতে চাঁদাবাজি করার যে অভিযোগ তা কীভাবে হয়?”

তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে দেশে-বিদেশে কোনো সম্পদ আছে কি না তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়া গেলে ‘দান করে দিতে প্রস্তুত আছেন’ জানিয়ে শরীফ উদ্দিন বলেছেন, “চাকরিতে যোগদানকালীন আমার দাখিল করা সম্পদের হিসাবের সাথে বর্তমানের সম্পদের ব্যাখ্যা যাচাই করুন।”

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর স্বাক্ষরে এক প্রজ্ঞাপনে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়।

সেখানে বলা হয়, “দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮- এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো।

“তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা (যদি থাকে) পাবেন। কমিশনের অনুমোদনক্রমে জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হল। যা ১৬ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ন থেকে কার্যকর গণ্য হবে।”

পর দিন বৃহস্পতিবার ওই আদেশ প্রত্যাহার ও ৫৪(২) বিধি বাতিলের দাবিতে সচিবকে স্মারকলিপি দেন দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি সহকর্মীকে অপসারণের প্রতিবাদে দুদক প্রধান কার্যালয়সহ সংস্থার অন্যান্য দপ্তরে মানববন্ধন করা হয়।

আরও পড়ুন