দেশে সবচেয়ে দূষিত গাজীপুরের বাতাস: গবেষণা

দেশব্যাপী বায়ুমান পরীক্ষা করে গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপস।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2022, 01:33 PM
Updated : 3 Feb 2022, 01:33 PM

বায়ূ দূষণের দিক দিয়ে গাজীপুরের পর ঢাকা দ্বিতীয় এবং নারায়ণগঞ্জ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বলে উঠে এসেছে তাদের গবেষণায়।

ক্যাপসের পরিচালক ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশের তিন হাজার ১৬৩টি স্থানের বাতাসে ভারী বস্তুকণার পরিমাণ পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে তাদের এ গবেষণায়।

বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।

আহমদ কামরুজ্জামান জানান, সমীক্ষায় দেখা যায়, ৬৪ জেলায় বায়ুতে গড়ে অতিক্ষুদ্র কণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম, যা দৈনিক গ্রহণযোগ্য মান ৬৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি।

গাজীপুরে এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম। পাশের জেলা ঢাকায় ২৫২ দশমিক ৯৩ এবং নারায়ণগঞ্জে ২২২ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ পাওয়া যায়।

এই তিন শহরের বাতাসে দূষণের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুন বেশি পাওয়া গেছে জানিয়ে অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, “রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ, মেগা প্রকল্প, আশেপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো এই তিন শহরে দূষণের অন্যতম কারণ।”

বায়ু দূষণের দিক দিয়ে ওই তিন জেলার পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ।

অন্যদিকে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে কম ছিল মাদারীপুরে, প্রতি ঘনমিটারে ৪৯ দশমিক শূন্য ৮ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ পাওয়া গেছে সেখানে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মাদারীপুরের পরের অবস্থানে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর জেলা।

এসব এলাকায় দূষণ কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, “এসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা এবং প্রাকৃতিক জলাধার লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া এসব এলাকার রাস্তায় সংস্কার কাজ চলতে দেখা যায়নি খুব একটা।”

বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে ‘ভালো’ বলা যায়।  এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়।

এই হিসাবে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ১০টি জেলায় বায়ুর মান ‘ভালো’ অবস্থায় পেয়েছেন ক্যাপসের গবেষকরা।

এই জেলাগুলো হল- কুড়িগ্রাম, নাটোর, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, পটুয়াখালী ও মাদারীপুর।

কামরুজ্জামান বলেন, “ভৌগোলিকভাবে এই জেলাগুলোর অবস্থান নদীর পাশে, এটা দূষণের বিস্তৃতি কম হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। রাজশাহী শহরে ভালো মানের বায়ু পরিলক্ষিত হওয়ার পেছনে রাজশাহী শহরের কর্তৃপক্ষের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।”

ক্যাপসের সমীক্ষায় আট বিভাগীয় শহরের মধ্যে বায়ু দূষণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা শহর, সেখানে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি মিলেছে প্রতি ঘনমিটারে ২৫২ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম। সবচেয়ে  কম দূষণ রাজশাহী বিভাগে, সেখানে গড়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫৬ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম।

উপকূলীয় এলাকার মধ্যে ১৯টি জেলার গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ১০৬ দশকি ৮২ মাইক্রোগ্রাম ছিল, যা গ্রহণযোগ্য মানের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ৬৪ গুণ বেশি।

ক্যাপসের পরিচালক বলেন, “উপকূলীয় এলাকার মধ্যে শুধু পটুয়াখালীর বায়ুমান ভালো পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালী এলাকা অতিমাত্রার দূষণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত।”

অপরদিকে খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, শরীয়তপুর, ঝালকাঠী, ভোলা, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, বরগুনা ও যশোরের গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ মধ্যম পর্যায়ের দূষণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত।

সংবাদ সম্মেলনে বায়ু দূষণ রোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কিছু সুপারিশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপস।

স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ

>> শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি দিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা;

>> নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও করে রাখা ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে রাখা;

>> রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে;

>> অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে;

>> ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ

>> সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বেশি পরিমাণ গাছ লাগানো এবং ছাদ বাগান করতে উৎসাহিত করা;

>> আলাদা সাইকেল লেইনের ব্যবস্থা করা;

>> দূষিত শহরগুলোর আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করা;

>> আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে স্যান্ড বক্লের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো;

>> সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ

>> প্রস্তাবিত নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা;

>> পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করা;

>> গণপরিবহসহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা;

>> সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা;

>> পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের নেতৃত্বে ৮১ সদস্যের একটি গবেষক দল এই সমীক্ষা পরিচালনা করে।

দেশব্যাপী বায়ু দূষণের বেইসলাইন তথ্য সংগ্রহ, জেলাগুলোর বায়ু দূষণের ক্রম এবং জেলা ভিত্তিক দূষণের মানচিত্র তৈরি করা এই গবেষণা উদ্দেশ্যে ছিল জানান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান।

অন্যদের মধ্যে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।