সিনহা হত্যাকাণ্ডের রায় কী হবে, জানার অপেক্ষা

আইনি বাহিনীর বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারে দেড় বছর আগে যে সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, আলোচিত সেই মামলায় অপেক্ষা এখন রায়ের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2022, 06:26 PM
Updated : 31 Jan 2022, 10:17 AM

কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলাটিতে সোমবার রায় দেবেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।

এই মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জন, বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে। সিনহাকে গুলিবর্ষণকারী হিসেবে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নাম আসামির তালিকায় ১ নম্বরে থাকলেও হত্যার মূল পরিকল্পনা ওসি প্রদীপের ছিল বলে তদেন্ত উঠে আসে।

এই হত্যাকাণ্ডের পরই বেরিয়ে আসে, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কীভাবে বন্দুকযুদ্ধ সাজিয়ে খুন করে যাচ্ছিলেন পোশাকী বাহিনীর কর্মকর্তা প্রদীপ।

আর তার ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহাকেও হত্যা করে তাকে ‘বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।

সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা খুন হওয়ার পর প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিজেদের ক্ষোভ নিয়ে এসেছিলেন প্রকাশ্যে।

সেই পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান ও পুলিশ প্রধান ঘটনাস্থলে গিয়ে বিরল এক সংবাদ সম্মেলনে একসঙ্গে বসে রাষ্ট্রীয় দুই বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্কে অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

তার এক মাসের মধ্যে কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ বদলে ফেলা হয়। সব পরিদর্শককে সরানোর পর পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়।

সেই ঘটনার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও কমে যায় লক্ষ্যযোগ্য হারে। সিনহা হত্যার আগের সাত মাসে যেখানে ১৮৪ জন মারা গিয়েছিলেন; পরের পাঁচ মাসে তা চারজনে নেমে আসে।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস যে মামলা করেন, তার কাজও চলে দ্রুত গতিতে।

সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিতে আদালতে তদন্ত কর্মকর্তা

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের পর র‌্যাব তদন্তভার নিয়ে পাঁচ মাসে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর অভিযোগ গঠন করে ২৯ কার্যদিবসে শুনানি করে গত ১২ জানুয়ারি রায়ের দিন ঠিক করে দেন বিচারক ইসমাইল।

সিনহা (৩৬) সেনাবাহিনীতে মেজর পদে ছিলেন। রোমাঞ্চপ্রিয় এই যুবক খুন হওয়ার দুই বছর আগে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়েন অন্যভাবে জীবন শুরুর জন্য।

ছোটবেলা থেকেই ছিল ভ্রমণের শখ, ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গিয়েছিলেন কক্সবাজারে।

তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ। সিনহার মৃত্যুর পর তাদেরও নির্যাতন ও হয়রানিতে ফেলেছিল পুলিশ।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ৫ অগাস্ট ওসি প্রদীপ দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয়জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন তার বোন।

সাড়ে চার মাস পর ১৩ ডিসেম্বর র‍্যাব-১৫ কক্সবাজারের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

পরের বছর ২০২১ সালের ২৭ জুন সব আসামির উপস্থিতিতে বিচারক ইসমাইল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

প্রায় দুই মাস পর ২৩ অগাস্ট বাদী শারমিন ফেরদৌসের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। মামলায় মোট সাক্ষী ছিলেন ৮৩ জন। তার মধ্যে নয়জন প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৬৫ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।

আসামি যারা

টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মো. লিটন মিয়া, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, টেকনাফ থানার কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং এএসআই সাগর দেব, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী স্থানীয় তিন ব্যক্তি নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ। আসামিরা সবাই রয়েছেন কারাগারে।

মামলা বিত্তান্ত

মামলা দায়ের: ২০২০ সালের ৫ অগাস্ট কক্সবাজারের আদালতে। নয়জনকে আসামি করে।

বাদী: সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।

অভিযোগপত্র দাখিল: ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ১৫ জনকে আসামি করে।

তদন্ত কর্মকর্তা: র‍্যাব-১৫ এর কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ এএসপি মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। তার আগে তদন্ত করেছিলেন র‌্যাব কর্মকর্তা এসএসপি জামিলুল হক।

অভিযোগ গঠন:  ২০২১ সালের ৩১ জুলাই। সব আসামির উপস্থিতিতে।

সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু: ২০২১ সালের ২৩ অগাস্ট।

মোট সাক্ষী: ৮৩ জন। সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ৬৫ জনের। তাদের নয়জন প্রত্যক্ষদর্শী।

সর্বশেষ সাক্ষী: তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।

আশায় বাদী ও আসামি উভয় পক্ষের আইনজীবীরা

দুর্নীতির মামলায় চট্টগ্রামের আদালতে প্রদীপ কুমার দাশ। ফাইল ছবি

সিনহা হত্যার ঘটনাটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আশা করছেন, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডই হবে।

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষ। ফলে আসামিরা খালাস পাবেন।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কক্সবাজারের পিপি ফরিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ রায়ের জন্য অপেক্ষায় আছি আমরা। মেজর সিনহা হত্যা মামলার দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই।”

তিনি বলেন, “আসামিরা যে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে, ষড়যন্ত্র করে মেজর সিনাহকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেটা আমরা স্পষ্টভাবে, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি।

“আমরা আদালতের কাছে নিবেদন করেছি, আগামীতে আইনের পোশাক পরে কেউ যেন এ রকম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে না পারে, সে রকম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই।”

এই রায়ের গুরুত্ব তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, “দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই এ জন্য যে, আইনের প্রতি মানুষের যেন শ্রদ্ধা থাকে, আইনের প্রতি যেন মানুষের আস্থা থাকে।”

অন্যদিকে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে ‘গরমিল’ ছিল দাবি করে আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মহিউদ্দিন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতে ৬৫ জন সাক্ষী উপস্থাপিত হয়েছে। তাদের যে সাক্ষ্য, সে সাক্ষ্যের সাথে বিজ্ঞ আদালতের বাদী পক্ষে দাখিলী যে এজহার ও তদন্তকারী কর্মকর্তার যে তদন্ত প্রতিবেদন রয়েছে, সে তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে যথেষ্ট গরমিল রয়েছে।”

তিনি বলেন, “বিজ্ঞ আদালতের কাছ থেকে আমরা ন্যায় বিচার পাব বলে আশা করি। যদি আশানুরূপ রেজাল্ট না আসে, রায় প্রত্যাশিত না হলে আইনগতভাবে আমাদের উপরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তা হলে আমরা আপিলে যাব।”

আসামি পক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে মনে হয়েছে, আইনানুগভাবে তদন্ত করা হয়নি। মনে হচ্ছে, কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি এভাবে মামলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে ওভারঅল সাক্ষী, প্রসিকিউশন-সেখানে বলেছি মাননীয় বিচারক যে রায় দেবেন আমরা মাথা পেতে নেব।”

“ওভারঅল মামলা যা আছে, তাতে ওসি প্রদীপ খালাস পাওয়ার যোগ্য,” বলেন ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ এই প্রবীণ আইনজীবী।

যেভাবে ঘটে সিনহা হত্যা

এখানেই হত্যা করা হয়েছিল সিনহাকে। ওসি প্রদীপ দাশকে ২০২০ সালের ২১ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে নেওয়া হয় তদন্তের জন্য।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভের সামলাপুরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি থামানোর পর তিনি বের হলেই তাকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছিলেন সিনহা; পানি চেয়েছিলেন, তা না দিয়ে তার বুকে লাথি মারেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, মুখ চেপে ধরেন মাটিতে। এরপর ওসি প্রদীপ এসে বুকে আবার লাথি মারার পর নিসাড় হয়ে পড়েন তরতাজা এই যু্বক। 

অভিযোগপত্রে বলা হয়, পুলিশের তিন সোর্সকে আগে থেকে সিনহার গতিবিধি দেখতে বলা হয়েছিল। ‘ডাকাত’ বলে তাদের উপর হামলার পরিকল্পনাও ছিল প্রদীপের।

কিন্তু সেই চেষ্টা সফল না হওয়ার পর সিনহা গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার পথে সাড়ে ৯টা ২৫ মিনিটে শামলাপুর চেকপোস্টে তাকে আটকানো হয়। তখন গাড়িতে সিনহার সঙ্গে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত।

অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, সিনহার পরিচয় শোনা মাত্রই লিয়াকত চিৎকার করে গাড়ির সামনে আসেন এবং উত্তেজিত হয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন। তখন এপিবিএন সদস্যরাও লিয়াকতকে রাস্তা আটকাতে সহায়তা করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “ওই সময় পরিদর্শক লিয়াকত আলী খুবই উত্তেজিত ছিলেন। পুলিশের নির্দেশ পেয়ে সিনহার সঙ্গী সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন।

“চালকের আসনে বসা সিনহা দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কামডাউন, কামডাউন’ বলে লিয়াকতকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এসময় সিনহাকে প্রথমে দুই রাউন্ড এবং কয়েক কদম এগিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত।”

এর পরই মাটিতে পড়ে যান সিনহা। গুলি করার পর সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন লিয়াকত আলী। এসআই নন্দ দুলাল গুলিবিদ্ধ সিনহাকে এ সময় হাতকড়া পরান। রশি এনে সিফাতকে বাঁধা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওসি প্রদীপকে ফোনে ঘটনা জানান পরিদর্শক লিয়াকত।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, “মেজর সিনহা তখনও জীবিত ও সচেতন ছিলেন- ব্যথায় গোঙাচ্ছিলেন, পানির জন্য মিনতি করছিলেন। লিয়াকত তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কী পানি খাওয়ানোর জন্য’।

“এরপর গুলিবিদ্ধ সিনহার বুকের বামপাশে জোরে জোরে লাথি মারেন এবং পা দিয়ে মাথা চেপে ধরেন লিয়াকত।”

এর মধ্যে ওসি প্রদীপ একটি মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ ভ্যানে ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে আসেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, “এসেই লিয়াকতের সঙ্গে ‘একান্ত আলাপ’ করেন ওসি প্রদীপ। আলাপ সেরে রাস্তায় পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান ওসি। সিনহা তখনও জীবিত, পানি চাচ্ছিলেন। এসময় সিনহাকে গালিগালাজ করে তার বুকের বাম দিকে জোরে লাথি মারেন প্রদীপ।

“একপর্যায়ে পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলায় পাড়া দিয়ে ধরলে তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরও কিছুক্ষণ সিনহার দেহ ঘটনাস্থলে ফেলে রাখে পুলিশ।”

রাত সাড়ে ১০টার পর সিনহাকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেসময় পুলিশের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি গাড়ি ছিল। এগুলোর কোনোটিতেই সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়নি। গুলি করার পর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল।

হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ছিলেন ভ্রমণপিয়াসী, রোমাঞ্চপ্রিয়।

মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ওসি প্রদীপ টেকনাফে যে খুন ও চাঁদাবাজি করতেন, তা ফাঁস হওয়ার ভয়েই সিনহাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ‘মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানায় নিরীহ মানুষের উপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী’ জেনে গিয়েছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা ও তার সঙ্গীরা। প্রদীপের অত্যাচারের শিকার কিছু মানুষের সাক্ষাৎকারও তারা নিয়েছিলেন।

বিষয়টি নিয়ে প্রদীপের সঙ্গেও সিনহা এবং তার সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের কথাও হয়। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে সিনহা ও তার দলকে ‘ধ্বংস করার’ সুযোগ খুঁজতে থাকেন প্রদীপ। তার পরিকল্পনাতেই চেকপোস্টে হত্যা করা হয় সিনহাকে।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে র‌্যাবের তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ বলেছিলেন, “সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল। প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।”

প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে হত্যার কারিগর ছিলেন তিনি।

সিনহার সঙ্গীদের ফাঁসানোর চেষ্টা

সিনহার সঙ্গে থাকা সঙ্গীরাও হয়েছিল নির্যাতিত।

সিনহাকে হত্যা করার পর তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে এবং হোটেল থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করে চালানো হয় নির্যাতন, চলে মামলার হয়রানি।

সিনহা খুন হওয়ার পরপরই সেনাবাহিনীর রামু ক্যান্টনমেন্টের সার্জেন্ট আইউব আলী ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পুলিশ সদস্যরা তাড়িয়ে দেন, যা পরে তিনি আদালতে সাক্ষ্যে বলেন।

সিনহা মারা যাওয়ার পর ওসি প্রদীপের সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা তার গাড়ি তল্লাশি করে মাদক পাওয়ার ঘোষণা দেন।

হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ, যা বানোয়াট ছিল বলে পরে তদন্তে উঠে আসে।

তবে সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর তাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ যা যা পুলিশ জব্দ করেছিল, সেগুলো র‌্যাবের হাতে যাওয়ার পর তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি বলে জানান বাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ। তার ধারণা, ডিজিটাল কনটেন্ট যা ছিল, তা ‘আগেই ধ্বংস করা হয়’।

তখন পুলিশের দেওয়া বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে ওই সব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে র‌্যাব জানায়, অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি।

প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ।

ওসি প্রদীপ: খুনের কারিগর

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার থাকাকালে ২০০৪ সালে পাথরঘাটায় এক বিধবা নারীর জমি দখলের অভিযোগে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন।

কক্সবাজার যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে আরও অভিযোগ ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে। নিজের সৎ বোনের জমি দখল, আইনজীবীকে মারধর এবং একটি বেসরকারি তেল শোধনাগারের লরি আটকে ও চালককে গ্রেপ্তার করে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

এরপর কক্সবাজারের মহেশখালী থানায় দুই বছর ওসিগিরি করার পর টেকনাফ থানার দায়িত্ব নিয়ে প্রদীপ মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে হত্যার কারিগর ছিলেন তিনি।

সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অপরাধ কর্মের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটি ‘পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ। “ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ ভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা,” প্রদীপকে নিয়ে বলা হয়েছ সিনহা হত্যামামলার অভিযোগপত্রে।

ব্যাপক আলোচনা ওঠার পর পুলিশ থেকে বরখাস্ত হয়ে ২০২০ সালের ৬ অগাস্ট আদালতের মাধ্যমে প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ অগাস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়া নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক সাংবাদিকও প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে।

ঘটনাস্থলে একসঙ্গে সেনা ও পুলিশপ্রধান

কক্সবাজারের সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ।

সিনহা হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ জানিয়ে জড়িত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তখন তারা কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

এই পরিস্থিতিতে ঘটনার ৫ দিন পর কক্সবাজারে গিয়ে বিরল এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

সিনহার নিহত হওয়াকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে জানায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উসকানি দিয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে সম্পর্কে যেন কেউ চিড় ধরাতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে বলেন তারা।

জেনারেল আজিজ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেজন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মর্মাহত এবং পুলিশ বাহিনী মর্মাহত। যে মেসেজটা আমরা দিতে চাই তা হচ্ছে- আমরা এটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে চাই।”

অপরাধীদের শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “এটার দায়-দায়িত্ব কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তাবে না। এখানে কোনো প্রতিষ্ঠান কাউকে সহযোগিতা করবে না আবার কারও বিপক্ষেও যাবে না।”

পুলিশপ্রধান বেনজীর বলেন, “অনেকে এই সুযোগে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছেন। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ সেনাবাহিনৗ এবং বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষ, চৌকস একটি ফোর্স। এই সমস্ত উস্কানি দিয়ে তারা কখনও সফল হতে পারবে না।”

বদলে গেল কক্সবাজার পুলিশ, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ও লাগাম

সিনহা নিহত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনার মধ্যে কক্সবাজার পুলিশে ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। ঘটনার পরদিনই টেকনাফের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ২০ জন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

পরবর্তীকে কক্সবাজারের সব পুলিশ পরিদর্শককে বদলি করা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়।

সিনহা হত্যাকাণ্ডের আগে কথিত বন্দুকযুদ্ধের অনেক ঘটনা ঘটলেও ৩১ জুলাইয়ের পর সারাদেশের এ চিত্র প্রায় শূন্যের কোটায় নেমেছিল কয়েকমাস। মাদক চোরাচালানের রুট হিসাবে বিবেচিত কক্সবাজারও ব্যতিক্রম ছিল না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ মাসের জানুয়ারি থেকে জুলাই এই সাত মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় ১৮৪ জন; প্রতি মাসে যেখানে ২০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে, সেখানে পরের পাঁচ মাসে এভাবে মারা পড়ে মাত্র চার জন। ২০২১ সালে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে দেশজুড়ে ৫১টি।

সিনহা হত্যার পর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে সব বিষয় খতিয়ে দেখে প্রতিবেদনে বলে, টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপের ৩৩ মাসের সময়কালে ১০৬টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ১৭৪ ব্যক্তি নিহত হয়।

অথচ ওই কাজের জন্যই ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডাল বা বিপিএম পেয়েছিলেন ওসি প্রদীপ। পদকপ্রাপ্তির সাইটেশনে তার ছয়টি ‘ক্রসফায়ারের ঘটনার’ উল্লেখ ছিল।