এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম তার প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানায় নিরীহ মানুষের উপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী’ জেনে গিয়েছিলেন সিনহা ও তার সঙ্গীরা। হুমকি দিয়ে সরাতে না পেরে সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা সাজানো হয়।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে এপিবিএন চেকপোস্টে ‘আর দশটা ক্রসফায়ারের মত সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায়’ সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। গুলিবিদ্ধ সিনহার ‘গলায় পা চেপে ধরে’ আনুমানিক সোয়া ঘণ্টা ফেলে রেখে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগী লিয়াকত।
“এরপর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকত তাদের সঙ্গীয় ফোর্সের সহায়তায় ভিকটিমের গাড়ি হতে মাদক উদ্ধারের ও সরকারি কাজে বাধাদানের ঘটনা সাজিয়ে তিনটি নিয়মিত মামলা রুজু করে এবং ভিকটিমসহ শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতে চরিত্র হননের জন্য বিভিন্ন অপচেষ্টায় লিপ্ত হন,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।”
সিনহা ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর, যিনি একসময় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসএসএফেও কাজ করেছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিনহাকে হত্যার পর তার ক্যামেরা ও অন্যান্য ডিভাইস নিয়ে সব ফুটেজ নষ্ট করে দেয় পুলিশ। এমনকি ঘটনার তদন্তের জন্য টেকনাফ থানার ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ভিডিও দিতেও গড়িমসি ছিল পুলিশের মধ্যে।
ঘটনাস্থলের অনেক অলামতও নষ্ট হয়। সিনহাকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি জব্দ করা হলেও ব্যবহৃত গুলির খোসা উদ্ধার করতে পারেননি র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা।
সিনহার মৃত্যুর পর কক্সবাজারের পুলিশ বলেছিল, তিনি তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
পুলিশের দেওয়া বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগগুলো এসময় আলোচনায় আসতে থাকে।
সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস তখন পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন কক্সবাজারের আদালতে। বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে অত্মসমর্পণ করেন। তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।
ঘটনার প্রায় সাড়ে চার মাস পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ১৫ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
সেখানে বলা হয়, সিনহার সঙ্গে সেই রাতে তার গাড়িতে ছিলেন শাহেদুল ইসলাম সিফাত। বাহারছড়া চেকপোস্টে সিনহাকে গুলি করে হত্যার পর ওসি প্রদীপের নির্দেশে সিফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে এবং গাড়িতে থাকা জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফ থানায়।
তদন্ত কর্মকর্তা লিখেছেন, “সিনহা ও তাদের ধারণকৃত ভিডিও চিত্র গায়েব করার জন্য প্রকৃত আলামত নষ্ট করাসহ সিনহাসহ তার সহযোগীদের চরিত্র হনন করার লক্ষ্যে এবং ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য গভীর রাত্রে নীলিমা কটেজে কোনো মহিলা পুলিশ ছাড়া হামলা চালিয়ে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া সিনহা এবং তার দলের লোকজনদের চরিত্র হননের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রচার মাধ্যমে প্রচারণা চালায়।”
এর অংশ হিসেবে টেকনাফ থনায় দুটি মামলা করে পুলিশ, যাতে সিনহা এবং তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আসামি করা হয়। এর একটিতে পুলিশের কাজে বাধাদান ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এবং অন্যটিতে গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগ করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার ১০ দিন পর জামিনে মুক্তি পান শিপ্রা ও সিফাত। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মামলার তদন্তভার যায় র্যাবের হাতে। ওই বছর ১৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে র্যাব জানায়, সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি।
আর হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই ও মামলার আসামি নন্দদুলাল রক্ষিত তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন ঘটনার রাতে সিনহার গাড়ি তল্লাশি করে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি।
সেই রাতে রামু সেনানিবাসের আর্মি সিকিউরিটি ইউনিটের (এএসইউ) সার্জেন্ট আইয়ুব আলী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মোবাইল ফোনে নিহত সিনহার ছবি তুললে ওসি প্রদীপের নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন এবং ঘটনাস্থল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়।
হত্যাকাণ্ডের পরপর সিনহা ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে মামলা তিনটি করেছিল, সেসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনো আলামত জব্দ দেখাননি। ফলে ওই আলামতও সংগ্রহ করা যায়নি।
গুলির খোসা না পেলেও যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়েছিল সেটি জব্দ করা হয়। টেকনাফ থানার বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নামে ৩০টি গুলিসহ জার্মানির তৈরি ওয়ালথার পিস্তলটি ইস্যু করা হয়েছিল। ২৬টি গুলিসহ সেই অস্ত্রটি জব্দ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলার তদন্তের প্রয়োজনে তদন্ত কর্মকর্তা ২৫ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত টেকনাফ থানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেয়েছিলেন। সেজন্য প্রথমে টেকনাফ থানায় যোগাযোগ করা হলে থানার ওসি এর জন্য এসপি বরাবর যোগাযোগ করতে বলেন। পরে আদালতে আবেদন করলে আদালত পুলিশকে ফুটেজ দিতে নির্দেশনা দেন বলে জানানো হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
সিনহাকে হত্যার পর যে কেবল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তা নয়, বিষয়টি নিয়ে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘উদাসীনতা’ ছিল বলেও উঠে আসে তদন্তে।
তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, “অবসরপ্রাপ্ত মেজর নিহত হওয়ার সংবাদে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও ঘটনার অব্যবহিত পর ঘটনাস্থলে তৎকালিন জেলা পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার জনাব এবিএম মাসুদুর রহমানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করা তার অপেশাদায়িত্ব ও অবহেলামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
“হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশ সুপারের এহেন আচরণ প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং জনমনে তার পক্ষপাতমূলক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে বলে মনে হয়েছে।”
তদন্ত কর্মকর্তার মনে হয়েছে, সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন এবং অপরাধীদের শনাক্ত করার বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের তদারকি/দায়িত্বপালনে আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃত ঘটনা এবং গৃহীত কার্যক্রমে একজন ঊর্ধ্বর্তন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার জনাব এবিএম মাসুদুর রহমানের তদারকিতে ঘাটতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। পুলিশ সুপারের এহেন অবহেলামূলক ও দায়িত্বহীন আচরণের প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয়/প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর/মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা যেতে পারে।”