‘মাসুদ রানা’ সিরিজ চলবে, জানাল ‘কাজীদা’র পরিবার

মাসুদ রানার স্রষ্টা প্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা সিরিজের অসমাপ্ত একটি বই শেষ করবেন তার ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেন; তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সহযোগী লেখকদের দিয়ে সিরিজটিও চালিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরিবার।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2022, 04:15 PM
Updated : 20 Jan 2022, 04:17 PM

কাজী আনোয়ার হোসেনের পুত্রবধূ মাসুমা মায়মুর বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মাসুদ রানা সিরিজের শেষ বইটি কাজী আনোয়ার হোসেন শেষ করে যেতে পারেননি; বইটি মায়মুর হোসেন শেষ করে পাঠকদের সামনে আনবেন।

বইটির নাম ও কাজী আনোয়ার হোসেন কত ভাগ লিখে গেছেন-সেই তথ্য জানাতে পারেনি মায়মুর হোসেনের স্ত্রী মাসুমা; ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে সামনে রেখে কাজী আনোয়ার হোসেন বইটি লেখায় হাত দিলেও অসুস্থতার কারণে সবশেষ চার মাস তিনি লিখতে পারেননি।

জেমস বন্ডের স্বাদ মাসুদ রানার মাধ্যমে দিয়ে বাংলাদেশের পাঠকের কৈশোরের নায়কের আসনে ঠাঁই করে নেওয়া কাজী আনোয়ার হোসেন ৮৫ বছর বয়সে বুধবার মারা যান। বৃহস্পতিবার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তাকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

ঢাকার সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার মসজিদে বৃহস্পতিবার দুপুরে কাজী আনোয়ার হোসেনের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কাজী আনোয়ার হোসেনের নামের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ও তার ইচ্ছা অনুযায়ী সহযোগী লেখকদের দিয়ে সিরিজটি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সেবা প্রকাশনী।

প্রকাশনীটির কর্মকর্তা মাসুমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৃত্যুর পরও মাসুদ রানা সিরিজ যেন চালু থাকে, সেটি বিবেচনায় রেখে ২০১৫ সাল থেকে সহযোগী লেখকদের সঙ্গে নিয়ে সিরিজটি চালিয়ে গেছেন বাবা। যাতে মাসুদ রানার পাঠকদের সঙ্গে সহযোগী লেখকদের পরিচিতি ঘটে; সঙ্গে সিরিজের ধাঁচটাও তারা বুঝতে পারেন।”

সিরিজের স্রষ্টা হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আগের মতোই সিরিজে মূল লেখক হিসেবে তার নাম থাকবে বলে জানান তিনি।

সহযোগী লেখক হিসেবে সবশেষ কয়েক বছর যারা তার সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে-কাজী মায়মুর হোসেন, ইসমাইল আরমান, ডিউক জন, সায়েম সোলায়মান সিরিজটি লিখবেন।

তাদের পাশাপাশি সহযোগী লেখক হিসেবে নতুনদের মধ্য থেকেও সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে সেবা প্রকাশনীর।

নিজের প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনী থেকে ১৯৬৬ সালে ‘ধ্বংস পাহাড়’ দিয়ে মাসুদ রানা সিরিজ লেখা শুরু করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। চরিত্রটি বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চরিত্রটি জিইয়ে রেখেছিলেন তিনি। সাড়ে পাঁচ দশকজুড়ে পাঠকদের কল্পনার রাজ্যে রাজত্ব করেছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই মাসুদ রানা।

সিরিজের সবশেষ বই ‘স্বর্ণলিপ্সা’ প্রকাশ হয়েছে গত বছর; এ বইয়ে মূল লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে সহযোগী লেখক হিসেবে মায়মুরের নাম দেখা গেছে।

কাজী আনোয়ার হোসেনকে ছাড়া সিরিজটি নেওয়াকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন কি না?-এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুমা বলেন, “খুব একটা না। যেহেতু উনি নামগুলোকে (সহযোগী লেখক) ২০১৫ সাল থেকে পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে গেছেন। ...তবে একটা নাম (কাজী আনোয়ার হোসেন) চলে গেলে সেটার প্রভাব কিন্তু পড়ে। সাইকোলজিক্যাল একটা ব্যাপার থাকে।

“তার আমানতকে সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আমরা রক্ষা করতে চাই। যথাযথ যত্নের সঙ্গে কাজটা করা হবে; যাতে পাঠক মাসুদ রানার প্রতি ভালোবাসা না হারায়। আমাদেরকে পাঠক কীভাবে নেবে...আমরা খুব একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়ব বলে মনে করি না। এটা নির্ভর করছে পাঠক কীভাবে গ্রহণ করবে তার উপরে।”

সহযোগী লেখকদের অভাবে গত কয়েক বছরে মাসুদ রানা সিরিজের বইয়ের সংখ্যা কমে এসেছিল; বছরে গড়ে চারটির মতো বই প্রকাশ হয়েছে। আগামীতে বইয়ের সংখ্যা বাড়া কিংবা কমার বিষয়টি নির্ভর করছে সহযোগী লেখকদের সংখ্যার উপর।

কাজী আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর সিরিজটি নিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস জানিয়েছে, লেখকের উত্তরাধিকাররা চাইলে চরিত্রটি জিইয়ে রাখতে পারেন।

মাসুদ রানা চরিত্রের সত্ত্বাধিকারী হিসেবে কপিরাইট করা না থাকলেও আনোয়ার হোসেনকেই চরিত্রের স্রষ্টা হিসেবে বিবেচনা করছে কপিরাইট অফিস। তার পরিবার বলছে, কপিরাইট করা না থাকলে সিরিজটি তারা ‘ট্রেড মার্ক’ করে রেখেছেন।

কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কাজী আনোয়ার হোসেনের উত্তরাধিকারের অনুমতি ছাড়া এখন কেউ সিরিজটি লিখতে পারবেন না।

আইন অনুসারে, মাসুদ রানার উত্তরাধিকারী হবেন কাজী আনোয়ার হোসেনের সন্তান কাজী শাহনূর হোসেন, কাজী মায়মুর হোসেন ও শাহরীন সোনিয়া।

সিরিজের গোড়ার দিকের ১১টি বই লিখে মাসুদ রানার ভিত্তি রচনা করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। পরে ‘ঘোস্ট রাইটার’ হিসেবে সেবা প্রকাশনীর কর্মকর্তা শেখ আব্দুল হাকিমকে দিয়ে সিরিজের ২৬০টি বই লিখিয়েছিলেন তিনি।

জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, “সিরিজের প্রথম ১১টি বই কাজী আনোয়ার হোসেন লিখেছেন; এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক কিংবা কারও কোনো দাবি-আপত্তি নেই। ফলে মাসুদ রানা চরিত্রটি উনিই সৃষ্টি করেছেন-এ বিষয়ে কারও সংশয় নেই।”

তবে আইনি জটিলতা এড়াতে মাসুদ রানার সত্ত্বাধিকারী হিসেবে আনোয়ার হোসেনের পরিবারকে সত্ত্ব পেতে আবেদনের আহ্বান জানিয়েছে কপিরাইট অফিস।

মাসুদ রানার স্রষ্টা হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনকে বিবেচনা করা হলেও সিরিজের চার শতাধিক বইয়ের মধ্যে ২৬০টি বইয়ের স্বত্ব পেয়েছেন শেখ আব্দুল হাকিম; আইনি লড়াইয়ের মধ্যে গত বছর তিনিও মারা গেছেন।

আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর শুধু সিরিজ লিখতে নয়; মাসুদ রানাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণেও পরিবারের অনুমতি নিতে হবে।

এর জন্য আলাদা কোনো ট্রাস্ট গঠন করা হবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের পরিবার জানিয়েছেন, ট্রাস্ট নয়, সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমেই কাজগুলো সম্পন্ন করা হবে।

কাজী আনোয়ার হোসেনের অনুমতি নিয়ে ১৯৭৪ সালে মাসুদ রানার প্রথম চলচ্চিত্রায়ন ঘটে সিরিজের ‘বিস্মরণ’ বইটি নিয়ে। কল্পনার মাসুদ রানার ভূমিকায় এসেছিলেন সোহেল রানা, সেটাই এই চিত্রনায়কের প্রথম সিনেমা।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্যাকেজ নাটকের শুরুও মাসুদ রানাকে নিয়ে। সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নিয়ে আতিকুল হক চৌধুরী তৈরি করেন নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’, যাতে মাসুদ রানার ভূমিকায় ছিলেন নোবেল, তার সঙ্গী সোহানা হয়েছিলেন বিপাশা হায়াৎ।

মাসুদ রানাকে নিয়ে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া।

সিরিজের ‘ধ্বংস পাহাড়’ উপন্যাস অবলম্বনে জাজের প্রযোজনায় ‘এমআর-নাইন’ শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন হলিউডের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পরিচালক আসিফ আকবর।

এ সিনেমায় মাসুদ রানার চরিত্রে তরুণ অভিনেতা এবিএম সুমনকে নির্বাচন করে গেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই; ভারতীয় গুপ্তচর সুলতা রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছেন বিদ্যা সিনহা মিম।

জাজের প্রযোজনায় ‘মাসুদ রানা’ নামে আরেকটি সিনেমা নির্মাণের অপেক্ষায় আছে ।