রোববার সকাল ৮টায় এ সিটির ১৯২ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে। এবারই প্রথম পুরো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ইভিএমে ভোট হল।
যন্ত্রে চাপ দিয়েই খুব সহজে ভোট দিতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন অনেকেই। আবার আঙুলের ছাপ না মেলায় বয়স্ক অনেকের ভোগান্তি হল। উৎসবের আমেজে ভোটের মাঠে দিনভর আলোচনায় থাকল ভোটগ্রহণের শ্লথ গতি।
শীতলক্ষ্যার তীরে প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ ভোটারের এই নগরে কতজন ভোট দিয়েছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। দুপুরে কেন্দ্র ঘুরে দেখার সময় এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বলেন, “আমরা বিভিন্ন কেন্দ্রে দেখলাম, কথা বললাম। চার ঘণ্টায় ভালো ভোট কাস্ট হচ্ছে। ভোটারের উপস্থিতিও ভালো রয়েছে।”
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, দুপুর পর্যন্ত কোনো কোনো কেন্দ্রে ৩০-৩৫% ভোট পড়ার তথ্য তিনি পেয়েছেন। বিকালে ভোট শেষে আদালত ভবন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আইয়ুব আলী ভুইয়া জানালেন, তার কেন্দ্রে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে তার ধারণা।
২০১১ সালে এ সিটির নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬৯ শতাংশ; তবে ২০১৬ সালে তা কমে ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশে দাঁড়ায়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে এবার ৫ লাখ ১৭ হাজারের ভোটারের মধ্যে কত শতাংশ ভোট দেন, তাই এখন দেখার বিষয়।
নারায়ণগঞ্জের সহকারী রিটার্নিং অফিসার আল আমিন বলেন, “৪টায় ভোট শেষ হয়েছে। এখনও অনেক ভোট কেন্দ্রে ভোটারের লাইন রয়েছে। কেন্দ্রের নির্ধারিত চৌহদ্দীতে থাকা ভোটারদের ভোট শেষ করেই ফলাফল তৈরির কাজ শুরু হবে।”
ইভিএমে আগের মত ভোট গোনার ঝামেলা নেই। ভোটগ্রহণ শেষে যন্ত্রই সব হিসাব করে দেবে। বাকি থাকবে শুধু কেন্দ্র ফল ঘোষণা এবং এজেন্টদের সই নিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠানোর আনুষ্ঠানিকতা।
ডিসি অফিসের সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শামিয়ানা আর মঞ্চও সাজিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। সেখান থেকেই একীভূত ফল ঘোষণা করা হবে সন্ধ্য থেকে।
ভোটারদের রায়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী টানা তৃতীয়বার মেয়র পদে থেকে যাবেন, না কি সেই চেয়ারে তৈমুর আলম খন্দকার বসবেন- তা জানার অপেক্ষায় এখন পুরো দেশ।
মেয়রের লড়াইয়ে ৭ জন
প্রার্থী | দল | প্রতীক |
সেলিনা হায়াৎ আইভী | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | নৌকা |
তৈমুর আলম খন্দকার | স্বতন্ত্র (বিএনপি) | হাতি |
এবিএম সিরাজুল মামুন | খেলাফত মজলিস | দেওয়াল ঘড়ি |
মো. মাছুম বিল্লাহ | ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ | হাতপাখা |
মো. কামরুল ইসলাম | স্বতন্ত্র | ঘোড়া |
মো. জসীম উদ্দিন | বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন | বটগাছ |
মো. রাশেদ ফেরদৌস | বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি | হাতঘড়ি |
মেয়র এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মিলিয়ে এ নির্বাচনে ১৮৯ জন প্রার্থী হলেও স্বাভাবিকভাবেই প্রচারের আলোয় ছিলেন চিকিৎসক আইভী ও আইনজীবী তৈমুর।
দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আইভী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে লড়েন। আর এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া বিএনপির নেতা তৈমুর দলের পদ ছেড়ে হাতি প্রতীক নিয়ে হন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
তাদের নিয়ে মোট সাতজন প্রার্থী এ সিটির মেয়র হতে ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন। এছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নারায়ণগঞ্জ সিটির তৃতীয় এই নির্বাচনে।
তবে ভোটের লড়াই ছাপিয়ে যে এই নির্বাচন জাতীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সে কথা আগেই বলেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তার ভাষায়, এ সিটি নির্বাচনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও নজর রাখছে।
পাঁচ বছর ধরে সমালোচনাবিদ্ধ কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য এই নির্বাচন ছিল শেষটা ‘ভালো’ করার চ্যালেঞ্জ। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর রাজধানীর পাশের এ নগরে নির্বাচন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোরণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রোববার সকাল ৮টায় এ সিটির ১৯২ কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। তবে মাঘের শীতের মধ্যে ভোটারদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে জড়ো হতে দেখা যায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের কিউ দীর্ঘ হয় কেন্দ্রের বাইরে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ভোটারকেও দেখা যায় ভোট দেওয়ার অপেক্ষায়।
২০১১ সালের নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হলেও এবারই প্রথম এ সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের এক হাজার ৩৩৩টি বুথে একযোগে ইভিএমে ভোট হয়। যন্ত্রে ভোট দেওয়ার বিষয়টি অধিকাংশের জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা।
আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী সকালে শিশুবাগ বিদ্যালয়ে ইভিএমে ভোট দিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেন। তবে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কদমতলীতে একটি কেন্দ্রে ইভিএম নষ্ট হওয়ার খবর পাওয়ার কথাও তিনি জানান।
সকালে নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি কোথাও কোথাও ভোটারের উপস্থিতি কম দেখে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, ‘ইভিএম-ভীতির কারণে’ হয়ত মানুষ কম।
ইভিএমে দ্রুত ভোট দিয়ে অনেকে যেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, বয়স্ক অনেকে আবার ভোগান্তিতে পড়েছেন আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে।
শিশুবাগ বিদ্যালয় কেন্দ্রের একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ বাদশা বলেন, “ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে অনেক সময় নিয়ে নিয়েছেন। আমরা বাইরে থেকে বলে দেওয়ার পরেও তারা বুঝতে পারছেন না। আবার অনেকে আছেন এক মিনিটের মধ্যে ভোট কাস্ট করে চলে যাচ্ছেন।”
কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট নিতে এই বিলম্বের ফলে ভোটারদের লাইনে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়েছে। ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নিজেও ভোটদানে গতির বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন, যাতে সবাই ভোট দিতে পারেন।
দুটি কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনা ছাড়া বড় কোনো গোলযোগ কোথাও হয়নি। একটি কেন্দ্রে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর স্ত্রী ও সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোনো কেন্দ্র বন্ধ হয়নি। অনিয়মের কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “ইভিএমে বেলা ৪টায় ভোট শেষ হয়েছে। আমরা যেমন ভালো নির্বাচন আশা করেছিলাম, সেরকম শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হল। কোনো ধরনের ঝামেলা ও গোলযোগ হয়নি; সুন্দর নির্বাচন হয়েছে।”
প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকার সকালে ভোট দিয়ে পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে নিজেদের জয়ের প্রত্যাশার কথাও বলেন।
ওয়ার্ডের দেওভোগের শিশুবাগ বিদ্যালয়ে ভোট দিয়ে আইভী বলেন, “আমি জানি, নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমাকে বেছে নিয়েছে। তারা অলরেডি নির্ধারণ করে নিয়েছে কাকে ভোট দেবে। ইনশাআল্লাহ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আইভীর জয় হবেই হবে, নৌকার জয় হবেই হবে। গণজোয়ারের জয় হবেই হবে।”
“যেটা সিদ্ধান্ত হবে, সেটাই মেনে নেব”, যোগ করেন দুইবারের মেয়র।
আর ইসলামিয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দিয়ে তন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, “ভোটের ব্যবধান হবে লক্ষাধিক, আল্লাহর রহমতে আমি লক্ষাধিক ভোটে জিতব।”
পরে বিকালে আরেক ব্রিফিংয়ে ইভিএমের ভোটের ‘ত্রুটি’, ভোটারদের ‘হয়রানি’ ও যুবদলের এক নেতাকে গ্রেপ্তার নিয়ে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর।
নিজেদের মেয়াদের শেষ সময়ে বড় নির্বাচনটি দেখতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তবে কেমন ভোট হচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য না করে শুধু বলেছেন. “বিদায় লগ্নে ভালো একটা নির্বাচন দেখতে চাই। তাই এখানে এসেছি।”
পরে ঢাকায় ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আমাদের কার্যকালে সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এটি ছিল আমার অনেক প্রত্যাশার স্থান। কারণ, আমি ইতোপূর্বে বলেছি যার শেষ ভালো, তার সব ভালো।”