‘খালি নিজের ভোটটা দিবার দিয়েন’

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের ভোটের প্রচার চলেছে উৎসবমুখর পরিবেশে। ভোটের দিনও যাতে এমন পরিস্থিতি থাকে, সেটাই চাইছেন স্থানীয়রা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নারায়ণগঞ্জ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2022, 10:31 AM
Updated : 15 Jan 2022, 10:43 AM

শুক্রবার শহরের চাষাড়া মোড়ে কথা হয় প্রতিবন্ধী অটোরিকশা চালক মনসুর আলীর সঙ্গে।

নারায়ণগঞ্জের শিবু মার্কেট এলাকায় পরিবার নিয়ে বাস করেন তিনি, গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে।

মনসুর বলছিলেন, গত বার ভোট দিতে গিয়ে মানুষ রীতিমতো ‘অপমানিত’ হয়েছে; এবার যেন সেটা না হয়।

মিশনপাড়া এলাকার গৃহিণী জোসনা বেগম সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তবে তার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়।

জোসনার কথায়, “বাবারে, গেলবার তোমার আঙ্কেলরে লইয়া গেলাম ভুট দিতে, স্কুলের (মর্গান স্কুল সেন্টার) ভিতরেই ঢুকতে দিল না। আনসাররা কয় সবাই লাঞ্চে গেছে, ভুট বন্ধ। এরপর পুলিশ আইসা খেদায়া দিল।

“এইবার কাউন্সিলরগো (প্রার্থীদের) লোকজন বাড়ি আইসা কইয়া গ্যাছে, ‘খালাম্মা আপনারে ভুট দিতে যাইতই হইব, কেউ কিচ্ছু কইলে আমরা আছি’। আমি কইছি, তোমার আঙ্কেল অসুস্থ, তাও যামু।”

নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ার আইডিয়াল স্কুলের এক নারী শিক্ষক গত নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন। তার ব্যাংক কর্মকর্তা ভাই এবার নির্বাচনী দায়িত্বে যাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক ও তার ভাইয়ের ধারণা, এবার সবাই প্রচার চালাতে পেরেছে, কোনও অঘটন হয়নি; ভোট সুষ্ঠু হবে।

গতবারের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ওই শিক্ষক বলেন, “আমরা দেখছি, আপনারাও দেখছেন কীভাবে ভোট হইছে গতবার। ওই ভোটের কারণে নৌকার প্রতি মানুষের একটা বিতৃষ্ণা আছে, অবিশ্বাস আছে।”

সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে পানি ছিটানো হচ্ছে সড়কে

আইভী না তৈমুর?

কোনো প্রার্থী এগিয়ে আছে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি না- জানতে চাওয়া হয় অটোরিকশা চালক মনসুরের কাছে। কথোপকথনের সময় শহরের রাস্তায় পানি ছিটাচ্ছিল সিটি কর্পোরেশনের দুটি গাড়ি। সেদিকে দেখিয়ে মনসুর বলছিলেন, “সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ নগরে দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মহামারীর সময় গেল বছর যখন নারায়ণগঞ্জের মানুষ খুবই আতঙ্কে, তখন এই গাড়িগুলো দিয়ে রাস্তায় ওষুধ ছিটানো হতো বলে মানুষকে জানানো হয়।

“এখন ধুলার মৌসুমে এই গাড়ি দিয়ে রাস্তায় পানি ছেটানো হচ্ছে। এটা মানুষের জন্য অনেক স্বস্তির। কিছু খাল দখলমুক্ত হয়েছে। শহরের পার্কটিতে (রাসেল পার্ক) গিয়ে এখন পরিবার নিয়ে বসার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আর তৈমুর সাহেবও শহরের পরিচিত লোক, তার ভাই খোরশেদ নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়।”

তৈমুরের ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন, এবারও কাউন্সিলর প্রার্থী।

মহামারীর সময় কোভিডে মারা যাওয়া মানুষের লাশ দাফন, স্থানীয় কর্মহীন মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়াসহ নানা উদ্যোগে দেশব্যাপী প্রশংসিত হন খোরশেদ। ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অনেকেই জানালেন, ভাইয়ের চেয়ে খোরশেদ জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে।

মহামারীকালে মাকসুদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের রবিদাস পাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “তারে কি আমরা ফিরাইতে পারি? আবার আইভী আপায় আমাগো রবিদাস পাড়ায় ২৪টা বাথরুম কইরা দিছে, দুইটা ড্রেন, একটা ডিপকল (পানির মোটর) বসাইয়া দিছে।

“আমরা জাতে হিন্দু, আমরা যেইহানেই ভোট দিই, লোকে কইব নৌকাতেই দিছি।”।’

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হাতেম আলী বললেন, “এমপিগো লগে আইভী আপার বাজাবাজি, এই কারণে শহরের মানুষ তার উপ্রে ভরসা পায়। তিনি পাবলিকের লগে চলেন … আর কিছু কওন লাগব আপনারে। আমাগো খালি নিজের ভোটটা দিবার দিয়েন।”

নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনে বরাবরই আলোচনায় আসে ওসমান পরিবার। এই পরিবারের দুই ভাই শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান এখন সংসদ সদস্য।

শামীম আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তার সঙ্গে আইভীর দ্বৈরথ দীর্ঘদিনের। এবার ভোটের প্রচারে শামীম ওসমানকে ‘গডফাদার’ বলে আলোচনায় আসেন আইভী।

স্থানীয়দের ধারণা, তিনি যে ওসমান পরিবারের সঙ্গে নেই, এটা স্পষ্ট করতেই আইভীর এই চাল ‘যথেষ্ট কার্যকরী’ হবে।

অবশ্য দলের চাপে শামীম ওসমানের অনুসারীরাও নৌকার প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন।

শামীম ওসমানের অনুসারীরা আপনার পক্ষে কাজ করেছেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে শুক্রবার আইভী বলেন, ‘আমি জানি না কে কাজ করেছে বা করে নাই। আমার দেখারও সময় ছিল না। কেন্দ্রীয় নেতারা এখানে ছিল, তারা দেখবেন।’

তৈমুর আলম খন্দকারের পক্ষে শামীম ওসমানের লোকজন কাজ করছে- এরকম খবর শহরে ছড়িয়েছে।

শুক্রবার জানতে চাওয়া হলে তৈমুর বলেন, “শামীম ওসমানের পাও দিয়া হাঁটার কোনো প্রয়োজন আমার নাই। আমি যখন নারায়ণগঞ্জের বড় নেতা, তখন শামীম ছাত্র। আমি এখনও হকার, ঠেলাগাড়ি চালক, হোটেল-রেস্তোঁরা শ্রমিক সংগঠনের নেতা।

“আরে ভাই এটা একটা অপপ্রচার। এই শামীম ওসমানের অফিসে বোমা হামলা চালিয়ে যখন ২২ জনকে হত্যা করা হলো, তখন তিনি আমাকে প্রধান আসামি করলেন। এখানে আমার চেম্বার জ্বালানো হয়েছে, বাড়ি-ঘর জ্বালানো হয়েছে। কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে এখানে আছি।”