কমলাপুর স্টেশন: ট্রেনে ওঠাও যেখানে ভোগান্তির নাম

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব হোসনে আরা যখন রাজশাহীগামী বনলতা এক্সপ্রেসের কামরায় ওঠার জন্য হাতল আকড়ে ধরে পাদানির চারটি ধাপ পার হওয়ার কসরত করছিলেন, শীতের মধ্যেও তার কপালে জমছিল ঘাম, চোখে ফুটে উঠছিল অসহায়ত্ব।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Jan 2022, 06:40 PM
Updated : 5 Jan 2022, 05:49 AM

অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং যানজটের ঝক্কি এড়িয়ে চলাচলের কারণে যাত্রীদের পছন্দের কাতারে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের রেল এতদিনেও যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। প্ল্যাটফর্ম থেকে বগির উচ্চতা অনেক বেশি হওয়ায় ট্রেনে উঠতে বয়স্ক, নারী, অসুস্থ আর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি।

হোসনে আরা থাকেন রাজশাহীতে, হাঁটুর ব্যথায় তার জন্য চলাফেরা করাও কষ্টকর। ডাক্তার দেখাতে ছেলে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এসেছিলেন ঢাকায়। শনিবার দুপুরে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে যান কমলাপুর স্টেশনে।

চারপাশের লোকজন তখন ছোটাছুটি করে যার যার বগিতে উঠতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই এক হাতে বৃদ্ধা মায়ের হাত ধরে, অন্য হাতে বড়সড় একটি লাগেজ টানতে টানতে ট্রেনের কাছে পৌঁছান হাবিব।

কিন্তু প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজের চেষ্টায় বগিতে ওঠার মত শারীরিক অবস্থা হোসনে আরার নেই। হাবিব প্রথম নিজে ট্রেন উঠলেন, তারপর টেনে তুললেন মাকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হাবিব বললেন, “মায়ের জন্য ট্রেনে ওঠার কষ্টটা বেশি হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের দরজায় ওঠার সিঁড়িটা একটু বেশিই উঁচু। বয়স্কদের উঠতে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক।”

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রওনা হওয়া ট্রেনটি ছাড়ার আগে উঠছে মানুষ। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম থেকে ব্রডগেজ ট্রেনের উচ্চতা বেশি হওয়ায় ট্রেনে উঠতে এবং মালামাল উঠাতে কষ্ট করতে হয় যাত্রীদের । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সমস্যাটা আসলে ট্রেনের নয়, প্ল্যাটফর্মের। কমলাপুর স্টেশনের প্লাটফর্মগুলো মূলত তৈরি হয়েছে মিটারগেজ ট্রেনের কথা মাথায় রেখে। আগে এই স্টেশনে আসা সব ট্রেনই ছিল মিটারগেজের।

ব্রডগেজ লাইনের ট্রেনগুলো আয়তনে ও উচ্চতায় মিটাগেজের তুলনায় বড় এবং উঁচু। কিছু ট্রেনের দরজা প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় আড়াই ফুট উঁচু। ব্রডগেজ ট্রেন চালুর আগে রেললাইন বর্ধিত করা হলেও প্ল্যাটফর্মগুলো রয়ে গেছে আগের উচ্চতায়।

ফলে বয়স্ক, অসুস্থ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ট্রেনে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়। ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারী ও শিশুদেরও। দুহাত দিয়ে ট্রেনের হাতল ধরে ব্যাগপত্র সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে ওঠা বয়সে তরুণদের জন্যও অনেকসময় কঠিন হয়ে যায়। এমনকি ট্রেনে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ার নজিরও আছে।

বনলতা এক্সপ্রেসেরই আরেকটি বগিতে উঠছিলেন মতিঝিলের বাসিন্দা শারমিন আক্তার বিথী। সাথে ছিল তার দুই বছর বয়সী মেয়ে আরিয়ানা আর নয় বছরের ছেলে আরমান।

কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার বলছেন, অসুস্থ ও বয়স্ক যাত্রীদের জন্য ব্রডগেজ ট্রেনে উঠতে সিঁড়ির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাস্তবে তার দেখা মেলেনি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো আরমানের কোলে আরিয়ানাকে দিয়ে শারমিন প্রথমে উঠলেন ট্রেনে। তারপর ঝুঁকে মেয়েকে টেনে কোলে নিয়ে ছেলেকে হাত ধরে টেনে তুলতে হল তাকে।

শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সড়কপথে যাতায়াতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি, আমরা তাই ট্রেনে যাতায়াত করি। কিন্তু ট্রেনে উঠতে গিয়ে যে পরিমাণ ঝামেলা পোহাতে হয়, সেটা খুব দুঃখজনক। আমি দুইটা বাচ্চা নিয়ে যাতায়াত করছি। এভাবে উঠতে গিয়ে তো অ্যাক্সিডেন্টও হতে পারে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে কমলাপুর স্টেশনের মাস্টার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের এমন ভোগান্তি হোক, তারাও তা চান না।

“এ সমস্যার সমাধানে চার এবং পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের সংস্কার কাজ চলছে। উঁচু ট্রেনগুলোতে ওঠার সুবিধার্থে প্ল্যাটফর্মগুলোকে সুবিধাজনকভাবে উঁচু করা হবে।

“তাছাড়া যেসব যাত্রীর ট্রেনে উঠতে সমস্যা হয়, কিংবা বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী, তাদের জন্য আলাদা কাঠের সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাত্রীরা তাদের সমস্যার কথা জানালে স্টেশনের কর্মীরা সেটা দরজার সামনে নিয়ে যায়।”

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রওনা হওয়া ট্রেনটি ছাড়ার আগে উঠছে মানুষ। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম থেকে ব্রডগেজ ট্রেনের উচ্চতা বেশি হওয়ায় ট্রেনে উঠতে এবং মালামাল উঠাতে কষ্ট করতে হয় যাত্রীদের । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

স্টেশন মাস্টর যতটা সহজে বললেন, ততটা সহজে অবশ্য সেই কাঠের সিঁড়ির দেখা মিললো না। অনেকক্ষণ ঘুরে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সিল্কসিটির এসি স্লিপার কোচের সামনে একটি কাঠের সিঁড়ি দেখা গেল। তবে শোভন চেয়ারসহ অন্যান্য বগিতে সেই লোহার পাদানি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন “ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। রেলওয়ের যে কোনো সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্ল্যাটফর্মের সংস্কারে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।”

২০২১ সালের অক্টোবর থেকে স্টেশনের চার এবং পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে সংস্কার কাজ চলছে। সে কারণে ওই দুটি প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামছে না। অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোতে যাত্রীদের গিজগিজে ভিড় লেগে থাকছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী রাজশাহী কমিউটারের যাত্রী সৃজন পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “অনেকেই মাস্ক পরে না। ফলে এখানে (ভিড়ের মধ্যে) করোনাভাইরাসের ঝুঁকি অনেক বেশি, বিশেষ করে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ।”

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ব্রডগেজ ট্রেনে শুধু স্লিপিং কোচের বগির সামনে রয়েছে সিঁড়ি, যা অন্য কোনো বগিতে পাওয়া যায়নি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তবে এ ব্যাপারে যাত্রীদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন স্টেশন মাস্টার তৌহিদুল। তিনি বললেন, “যাত্রীদের সুবিধার জন্যই স্টেশনে সংস্কারের কাজ চলছে। এ কাজ থেমে গেলে যাত্রীদেরই অসুবিধা হবে। তাই তাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে। সাময়িক কিছু অসুবিধা থাকবেই।”

কমলাপুরে ভোগান্তি আরও আছে। স্টেশনের বিভিন্ন জায়গায় মালপত্র বহনের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখা গেলেও কুলিরা তা মানে না বলে অভিযোগ করলেন যাত্রীদের অনেকেই।

পাশাপাশি কুলির মাধ্যমে স্টেশনে ট্রলি ব্যবহার করতে গিয়েও বেশ ভোগান্তিতেও পড়তে হয় বলে তারা জানালেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তৌহিদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনটা হওয়ার কথা না। যদি কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কুলিরা বেশি ভাড়া দাবি করে, তাদের অনুরোধ করব, তারা যেন কর্তৃপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে এবং অফিসিয়ালি অভিযোগ জানায়। এক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”