বছর জুড়ে ডেঙ্গু, ঢাকার বাইরে বাড়ছে প্রকোপ

এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু কেবল বর্ষাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, সারাবছর এমনকি শীতের সময়ও এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে; রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাতেও বাড়ছে এর প্রকোপ।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2021, 02:42 PM
Updated : 31 Dec 2021, 04:15 PM

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের সময় পাল্টে যাওয়ায় বছরজুড়েই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে; অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে সারাদেশে বংশ বিস্তারের পরিবেশ পাচ্ছে এইডিস মশা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি ডিসেম্বর মাসে ঢাকার চেয়ে অন্যান্য জেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে বেশি। এ মাসে আক্রান্ত ১ হাজার ১৭২ জনের মধ্যে ঢাকায় ৫৮০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৯২ জন।

২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৮ হাজার ৩৯৪ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১০৪ জনের। এ বছর মোট আক্রান্তের ৪ হাজার ৭৮৩ জন ঢাকার বাইরের।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মনোজ দাস ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন গত বৃহস্পতিবার। চিকিৎসা শেষে এখন অনেকটাই ভালো তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করেন। সম্প্রতি তার ১৩ সহকর্মী এবং ৪ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

ঢাকা থেকে আসা কোনো সহকর্মীর মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে, এমন ধারণার কথা তুলে ধরে মনোজ বলেন, “আমি ছোটোবেলা থেকে উখিয়ায় থাকি। ডেঙ্গু এখানে কখনও ছিল না। কিন্তু এখন রোগী পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগই পরীক্ষা হয় না, হলে আরও বেশি রোগী শনাক্ত হত।”

এইডিস এজিপ্টি ও এইডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে এইডিস এজিপ্টি ডেঙ্গু ছড়ালেও ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর জন্য এইডিস অ্যালবোপিকটাসকেও দায়ী করা হয়।

মার্চ থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়ে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোগী পাওয়া যায় বেশি। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে বছরের অন্যান্য মাসেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতি মাসেই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে।

 

অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর সিজন হওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়ের আগে-পরে বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর মৌসুমও প্রলম্বিত হয়।

“জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের সময় ঠিক থাকছে না। এই ডিসেম্বরেও বৃষ্টি হয়েছে। থেমে বৃষ্টিপাত হলে এইডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়, হচ্ছেও তাই।”

ডেঙ্গু আক্রান্তের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১২৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে গাজীপুরে। কক্সবাজারে শনাক্ত হয়েছে ৩৪২ জন, জেলাগুলোর মধ্যে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

চলতি ডিসেম্বর মাসের বিভিন্ন তারিখে মোট ১১দিন ঢাকার চেয়ে দেশের অন্যান্য জেলায় ডেঙ্গু রোগী বেশি শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

তারিখ

ঢাকা

অন্য জেলা

মোট

১ ডিসেম্বর

৩৯

৮২

১২১

২ ডিসেম্বর

৪৬

৬২

১০৮

৪ ডিসেম্বর

২৪

২৯

৫৩

৭ ডিসেম্বর

২৮

৯১

১১৯

১৩ ডিসেম্বর

১৫

২৭

৪২

১৯ ডিসেম্বর

১৮

৩২

৫০

২০ ডিসেম্বর

১৭

২২

৩৯

২২ ডিসেম্বর

১০

৬০

৭০

২৩ ডিসেম্বর

১৭

২৪

২৬ ডিসেম্বর

২৮ ডিসেম্বর

১০

১৫

তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু কেন ছড়াচ্ছে জানতে চাইলে ডা. বে-নজীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেলা ও মফস্বল শহরগুলোতেও অপরিকল্পিত নগরায়ন বাড়ছে, এটি একটি কারণ।

“গ্রামাঞ্চলেও নানা ধরনের যানযাহন ব্যবহার হয়। এসব যানবাহনের পুরোনো টায়ার যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। গ্রামেও এখন অনেক নির্মাণকাজ হওয়ায় স্বচ্ছ পানি জমে থাকার সুযোগ রয়েছে।

“এসব জায়গায় এইডিস মশা সহজে জন্মাতে পারে। ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ এখন এত নিবিড়, ঢাকা একটা বাস যাচ্ছে কোনো জেলা শহরে। এই বাসের সঙ্গে এইডিস মশা চলে যাচ্ছে।”

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এইডিস মশা ‘স্থায়ী হয়ে উঠছে’ মন্তব্য্য করে বে-নজীর আহমেদ বলেন, “বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পেয়ে প্রজনন করছে। সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সঙ্গে করে ভাইরাস নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সেখানে একটা জীবনচক্র তৈরি হচ্ছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ২৪ হাজার ২৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৩৭ জন, ২০১৭ সালে ১১৬ জন এবং ২০১৮ সালে ৫ জন মিলিয়ে ২৫৮ জন রোগী ঢাকার বাইরের।

সারাদেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার ঘটে ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক ৪৯ হাজার ৫৪৪ জনই ছিলেন ঢাকার বাইরের।

২০২০ সালে আক্রান্ত ১ হাজার ৪০৫ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ২২৪ জন, আর ঢাকার বাইরের ১৮১ জন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কোনো ডেঙ্গু রোগী পাওয়ার তথ্য নেই।

 

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম প্রধান বলেন, ২০১৯ সালে ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বেশি ছড়িয়েছিল।

“সেবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই ঈদের সময় অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। তাদের সঙ্গে ডেঙ্গুর জীবাণুও ছড়িয়েছে। মশা দেশের সবখানেই আছে, কিন্তু ডেঙ্গুর ভাইরাস ছিল না। ওই আউটব্রেকের সময় ডেঙ্গুটা ঢাকার বাইরে ছড়িয়েছে বেশি। যখনই ছড়িয়ে পড়ল, তখনই ওই ভাইরাসটা সেটল করার সুযোগ পেল।

“ভাইরাস কোনো জায়গায় একবার গেলে তা আর শেষ হয় না। চট্টগ্রাম ও খুলনায় ডেঙ্গু রোগী আগেও পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন সব জায়গায় ডেঙ্গু পাওয়া যাবে।”

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বর্ষার আগেই এইডিস মশার প্রজনন বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ যেন নেওয়া হয়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান ডা. নওশের আলম।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় কিছু সচেতনতা তৈরি হয়েছে, সেখাবে কিছু কাজও হচ্ছে।

“কিন্তু ঢাকার বাইরে মানুষ এত সচেতন না। গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। এমন কি অনেক পৌরসভায় মশক নিধন কার্যক্রম নাই। ফলে ঢাকার বাইরে বেড়ে যাচ্ছে।”

মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সক্রিয় হয়ে মশক নিধন কার্যকম জোরদার করার আহ্বান জানান প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক।

আরও পড়ুন