এর মধ্যেই এল খ্রিস্টীয় নতুন বছর, ২০২২ সাল। নতুন বছর নতুন শুরুর উপলক্ষ হয়ে বরাবর এলেও সেই আশায় এবার শঙ্কাও মিশে থাকল।
টিকায় সংক্রমণ এড়িয়ে থাকা যাবে কি না, আবার মৃত্যুর মিছিল শুরু হবে কি না, খুলে যাওয়া স্কুল খোলা থাকবে কি না, অফিস-আদালত আবার চলবে কি না, অর্থনীতির গতি ফিরবে কি না, জীবিকার সঙ্কট কাটবে কি না, সেই প্রশ্নগুলোই মুখ্য হয়ে উঠেছে নতুন বছরের শুরুতে।
শঙ্কা যে আছে, সে তো বর্ষবরণের উৎসবে সতর্কতার লাগাম দেখেই স্পষ্ট। কেন- তার ব্যাখ্যায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্য এসেছে, “বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি ইউরোপের বর্তমান অবস্থার মতো হোক, তা সরকার চায় না।”
এই মহামারীর শুরুটা হয়েছিল ২০১৯ সালের একেবারে শেষ দিকে, তারপরই বদলে যেতে থাকে বিশ্ব। সংক্রমণ এড়ানোর নজিরবিহীন এক লড়াইয়ে মানুষকে হতে হয় ঘরবন্দি।
মহামারীর হানা ঘটেছিল বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে; যখন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নানা সোপান পেরিয়ে বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছিল, সেই সঙ্গে উদযাপন হচ্ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী।
দুই উদযাপনকে সঙ্গী করে যখন নতুন স্বপ্নের পথে ডানা মেলার কথা বাংলাদেশের, তখন তা অনেকটাই গুটিয়ে যায় মহামারীর ছায়ায়।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর বাংলাদেশে হানা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় জমে থাকা অব্যবস্থাপনা প্রকট হয়ে ওঠে; দীর্ঘদিন অপ্রকাশ্যে থাকা দুর্নীতিও হয়ে পড়ে প্রকাশ্য। তারমধ্যেই চলে কোভিড মোকাবেলার লড়াই।
সেই লড়াই গতি পায় বিদায়ী বছরে টিকা আসার মধ্য দিয়ে; গত ফেব্রুয়ারিতে যখন বাংলাদেশ টিকা দেওয়া শুরু করে, তখনও অনেক দেশে টিকা পৌঁছায়নি। শুরুটা ভালোই ছিল, কিন্তু তারপরই ছেদ ঘটে ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর।
করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে ভারত বিপর্যস্ত হওয়ার পর বছরের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশেও পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে। সংক্রমণ আর মৃত্যুর রেকর্ডের পর রেকর্ড হতে থাকে জুন, জুলাই, অগাস্টে। ২০২০ সালের মতো আবারও ফেরাতে হয় লকডাউন।
তার মধ্যে অবশ্য টিকা আসায়ও গতি বাড়ে। বিশ্বে প্রয়োগের দিক থেকে শীর্ষ তালিকায় থাকা সব টিকাই এসে যায়।
বছরের শেষ নাগাদ সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে, তার মধ্যে ৫ কোটির বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজও পেয়ে গেছেন। বুস্টার ডোজও দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।
আশাবাদী কণ্ঠে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেছিলেন, “আমরা ষাটোর্ধসহ একটা টার্গেট পিপলকে যদি বুস্টার ডোজ দিতে পারি। মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি যদি মেনে চলতে পারি, তাহলে হয়ত আরেকটা বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাব।”
তার এই আশায় বাদ সাধছে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। ওমিক্রন সংক্রমিত বেশ কয়েকজন রোগীও ধরা পড়ে বছরের শেষ মাসে।
ফলে দেড় বছর পর গত সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও তা খোলা রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে কর্তাব্যক্তিদের মনেও।
কোভিড মহামারীতে দীর্ঘ সময় সরাসরি ক্লাস বন্ধ থাকায় যে ভুগতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের, তা ফুটে ওঠে উত্তরা মডেল স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী এরফান সিদ্দিকীর মা শাহিদা খাতুনের কথায়।
“অনলাইনে ক্লাস শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো কাজে আসেনি। আমি নিজে দেখেছি, আমার ছেলে ওইসব ক্লাস থেকে খুব একটা উপকার পায়নি। আশার কথা বছরের শেষে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যায় খুলেছে। ছেলে-মেয়েরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।”
এখন বেশিরভাগ শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহে দুদিন চললেও নতুন বছরে সরাসরি ক্লাস পুরোদমে শুরুর আশা করছেন এই অভিভাবক। কিন্তু তা কী হবে, সেটা এখনও স্পষ্ট করতে পারেননি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বলেছেন, এখনকার মতোই সীমিত পরিসরে ক্লাস শুরু হবে নতুন বছরে, এরপর অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় সঙ্কট হিসেবে এসেছে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, যা মূলক মহামারীর অর্থনৈতিক অভিঘাত হিসেবে এসেছে। পরিবার অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ায় অনেক নারী শিক্ষার্থীকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে, আর পুরুষ শিক্ষার্থীকে কাঁধে নিতে হয়েছে সংসারের জোয়াল।
ঝরে পড়া এই শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করাটা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তাদের ক্লাসে ফেরাতে আর্থিক সহায়তা দিতেও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মহামারীর ধাক্কা এক কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন।
চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামরত দিনমজুর হোসেন আলী বলেন, “খাওয়াইয়া পাঁচজন। কোনো দিন কাম না পাইলে কোনোরকম থাকতে হয়। এইভাবে দিন যায়, রাইত আসে।”
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্তের মাসের জমা-খরচের হিসাব মেলানোও কঠিন করে তুলেছে।
তার মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশের যোগ্যতা অর্জনের খবরটি এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সূচকও সুসময়ের বার্তা দিচ্ছে।
তবে তাতে ছায়া ফেলছে রেমিটেন্স। মহামারীর মধ্যে চাঙা ২০২০ সাল পেরিয়ে দেশের বৈদেশিক অর্থ আয়ের দ্বিতীয় প্রধান এই খাতে এখন চলছে অধঃগতি। দেশে ফিরে আসা রেমিটেন্স যোদ্ধাদের আবার ফিরে যাওয়াও পড়েছে অনিশ্চয়তায়।
সৌদি আরব থেকে কাজ হারিয়ে ফিরে আসা কলিম উল্লাহ নিদারুণ দুশ্চিন্তা নিয়ে বলেন, “বিদেশে চাকরি করে যা কামাই করেছি, সব এখন কমতে শুরু করেছে। দেশে তো চাকরি নেই। বুকের ভেতর কষ্ট আর ব্যথা নিয়ে কাটছে দিন।”
সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নতির অনুবাদ ব্যক্তি জীবনে তেমন দেখা না গেলেও আশায় ভর করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী রোকসানা জামিল।
“পদ্মা সেতু ও ঢাকা মেট্রোরেলের দ্বার উন্মোচন হবে এই বছরেই। কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসার সুবাদে অর্থনৈতিক সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী হবে।”
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরও বলছেন, সংক্রমণের প্রথম বছরের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক ভালো। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ঊর্ধ্বমুখী, আশা করা যাচ্ছে সামনের দিকে এগুলো আরও ভালো হবে।
অর্থনীতির এগিয়ে চলার এমন আশার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে থাকবে রাজনীতি, যেখানে স্থিতির সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। বরং ভোটের আগের বছরে অস্থিতির আঁচই লাগছে।
দুর্গাপূজার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা দেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আর তার সঙ্গে যে রাজনীতির যোগ আছে, সেকথা বলছেন প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত। তার ভাষায়, বড় রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানকে ‘সাম্প্রদায়িকরণ’ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট করেছে।
এরমধ্যে ঘরবন্দি রাজনীতির বড় দুয়ার বিদায়ী বছরে খুলেছিল ইউনিয়ন পরিষদের মধ্য দিয়ে। সেখানেও সংঘাত আর সহিংসতায় হারায় ভোটের উৎসবের রঙ।
অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর দাবি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দূরত্ব ছিলই, এরমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপ বিএনপির বর্জন করায় সেই দূরত্ব দৃশ্যত আরও বেড়েছে। এবার যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, তাদের পরিচালনায়ই হবে আগামী সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনের দুই বছর আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পুরনো দাবিটিই আবার সামনে আনছে বিএনপি, যে দাবি পূরণ না হওয়ায় আট বছর আগে ভোট বর্জন করে তাদের আন্দোলনে সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল।
সেই সহিংসতা আর অপরাজনীতির জন্য জনগণ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, ফলে তাদের অবস্থা এখন ক্ষয়িষ্ণু বলে দাবি করে আসছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
কিন্তু র্যাবের কর্মকর্তাদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়তে যাচ্ছে দাবি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর ডাক আবার দিতে শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা।
ওই নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় প্রভাবও দেশের রাজনীতির উপর পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে অনেকের মনে। ফলে অর্থনীতির ভালো রাজনীতির মন্দে না হারিয়ে যায়, সেই সেই ভয় নিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন বছরের পথচলা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৩ সাল থেকেই নির্বাচন নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল হতে হলে একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় নির্বাচন দরকার। সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সবাই প্রত্যাশা করে।
“কিন্তু আমাদের দুঃখের বিষয়, এত বছরেও এটাতে আমরা একমত হতে পারছি না। যতদিন পর্যন্ত সেখানে মতৈক্য না আসবে, ততদিন একটা শঙ্কা তো রয়েই যাবে।”
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতির প্রতিফলন রাজনীতিতেও প্রত্যাশা করছেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
“দুঃশ্চিন্তার বিষয় হল, সুশাসন ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা বার বার ব্যর্থ হয়েছি। আমরা দেখেছি, কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও নানা ধরনের সহিংসতা হয়েছে। একদিকে নারী প্রতি সহিংসতা, অপরদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সম্প্রতি ইউপি ইলেকশনেও সহিংসতা হয়েছে।বাংলাদেশে আমরা ক্রমাগত দেখছি যে, সহিংসতা কমছে না। সেই সহিংসতার পথ থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে।”
“আগামী বছর আমরা একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে সর্বস্তরের মধ্যে মানবিক ও সহনশীল একটি কালচার গড়ে উঠবে, রাজনীতিবিদ, জনসাধারণ ও কমিউনিটির মধ্যে সসহনশীলতা বিরাজ করবে। আমরা সেটাই প্রত্যাশা করি,” নিজের প্রত্যাশা প্রকাশ করেন রওনক জাহান।