শুরু হচ্ছে নগর পরিবহনে ‘শৃঙ্খলা ফেরানোর’ পরীক্ষা

রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে দীর্ঘ সময়ের এক প্রচেষ্টা অবশেষে বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে; বাস রুট ফ্যাঞ্চাইজির আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে একটি রুটে একক কোম্পানির অধীনে বাস চলাচল শুরু হচ্ছে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2021, 06:54 PM
Updated : 25 Dec 2021, 07:07 PM

রোববার ঘাটারচর থেকে কাচপুর পর্যন্ত ৫০টি বাসের মাধ্যমে এ যাত্রা শুরু হবে, যেটিকে ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহনকে পাল্টে দেওয়ার এক উদ্যোগ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামের কোম্পানি গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু এ কার্যক্রমে বর্তমানে এ রুটে অন্য কোম্পানির বাসও চলবে। ৩১ জানুয়ারির পর অন্য বাস থাকবে না।

২১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুটের বাস কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর ডিপো থেকে বাস ছেড়ে বসিলা, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শংকর, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, নটর ডেম কলেজ, ইত্তেফাক মোড়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড হয়ে কাচপুর ব্রিজ পর্যন্ত যাবে।

‘ঢাকা নগর পরিবহন’ এর যাত্রার মাধ্যমে মহানগরীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার কার্যক্রম রোববার শুরু করতে পেরে আশার কথা জানিয়েছে বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

ঘাটারচর থেকে কাচপুর ব্রিজ পর্যন্ত রুটে বাসের টিকেট কাটতে ২৫টি কাউন্টার থাকবে। সবাইকে টিকেট কেটেই বাসে উঠতে হবে।

একইভাবে ফিরতি পথেও ২৫টি জায়গায় কাউন্টার থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম।

বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তিনি।

এখন ঢাকা শহরে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়া সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা দিতে হবে।

ঢাকার মাতুয়াইলে ঢাকা নগর পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বাস । রোববার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাচপুর পর্যন্ত প্রায় ২১ কিলোমিটার রুটে চলবে এই বাস সার্ভিস । ছবি: ওবায়দুর মাসুম

শৃঙ্খলা ফিরবে: কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

এ পদ্ধতি চালু হলে নগরবাসীর সামনে গণপরিবহনের নতুন অভিজ্ঞতার দুয়ার খুলবে। কয়েক দশকের বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থায় যাত্রী হয়রানি কমবে বলেও আশা সংশ্লিষ্টদের।

নতুন গঠিত ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ এর চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম খোকন। এ রুটে শুরুতেই তার কোম্পানি ট্রান্স সিলভা বিডির ২০টি বাস চলবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সরকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে সহায়তা করবে বেসরকারি পরিবহন মালিকরাও।

তার আশা পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা নিয়ে পুরো ঢাকায় এ সেবা ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে, যাত্রীসেবা বাড়বে।

বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি তাপস এ পদক্ষেপকে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় ‘নতুন দিগন্ত’ হিসেবে দেখছেন।  

পরীক্ষামূলক এ যাত্রার পর বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমের আওতায় পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকা মহানগরীকে ‘শৃংঙ্খলবদ্ধ গণপরিবহন অন্তর্জালে’ নিয়ে আসার কথা বলেছেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “২০২২ সালের মধ্যে পুরো গ্রিন ক্লাস্টারকে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকা মহানগরীতে বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নে সক্ষম হব বলে আশাবাদী।“

সবুজ রঙের প্রলেপ পড়েছে বাসে, হচ্ছে নতুন নাম ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। ঢাকার মাতুয়াইলে ঢাকা নগর পরিবহনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বাস। ছবি: ওবায়দুর মাসুম

৪২ রুটে হবে বাস ফ্রাঞ্চাইজি

শুধু এ রুটে নয়, নগরের গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে সব রুটেই পর্যায়ক্রমে ফ্রাঞ্চাইজি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সংক্রান্ত কমিটি।

বর্তমানে ঢাকায় ৩৮৬টি রুটে বাস চলাচল করে। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি এসব রুট কমিয়ে ৪২টিতে নিয়ে এসেছে।

এসব রুট নিয়ে লাল, সবুজ, নীল, বেগুনী, গোলাপি ও কমলা- এ ছয় ক্লাস্টার করা হয়েছে।

ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত রুট সবুজ ক্লাস্টারের আওতায়। এসব বাসের রঙ হবে সবুজ।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের বিআরটিসির বাস ডিপোতে রাখা এই পাঁচটি বাস রোববার সড়কে নামবে নগর পরিবহনের বহরে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শুরুর কথা

রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা এবং যানজট নিরসনে বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি চালুর জন্য দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।

রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন রুটে পরিবহন সংস্থাগুলোর বাসের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে এবং পুরনো বাস তুলে নিতে এমন পদক্ষেপের চিন্তাভাবনা শুরু হয় প্রায় দেড় দশক আগে। সেই পরিকল্পনাই অবশেষে বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে।

আগের চিন্তাভাবনার সূত্র ধরে ২০১৬ সালে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ফ্রাঞ্চাইজির আওতায় বাস পরিচালনার উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়।

এ কমিটির কাছে রাজধানীতে নয়টি ক্লাস্টারের মাধ্যমে ২২টি কোম্পানির ৪২টি রুটে বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রস্তাব দেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে এসব ক্লাস্টার চূড়ান্ত করেছে এ কমিটি।

বর্তমানে কমিটির সভাপতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ডিটিসিএ এর নির্বাহী পরিচালক কমিটির সদস্য সচিব।

কমিটিতে আছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, বিআরটিসি, রাজউক, ঢাকা মহানগর পুলিশ, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা।

কমিটি এ পর্যন্ত ২০টির বেশি বৈঠক করেছে। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে এবং বাস মালিকদের ‘কথা না রাখার’ অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে অবশেষে রোববার নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন ঢাকার এক অংশের নগর পরিবহন ব্যবহারকারীরা।

এ পরীক্ষার সফলতার ওপর নির্ভর করবে নগরীর বাকি রুটগুলোকে একই ব্যবস্থার আওতায় আনা।    

কোরবানির ঈদের আগে লকডাউন তুলে নেওয়ায় বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার গাবতলী এলাকায় ছিল তীব্র যানজট। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কতটুকু প্রস্তুত

শুক্রবার এ রুটে যেসব বাস চলবে সেগুলোর বড় দুটো ডিপো ঘুরে দেখা গেছে, বাসকে রঙ করার পাশাপাশি মেরামত ও সংস্কারের কাজ চলছে।  

চালকদের ওরিয়েন্টেশনের পাশাপাশি তাদের সব তথ্য বিআরটিসি থেকে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।

ডিটিসিএর ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বেসরকারি বাসের চালকদের তালিকা মালিকরা পাঠিয়েছেন। বিআরটিএ থেকে সব তথ্য যাচাই করা হয়েছে। শুক্রবার এসব চালকসহ মোট ৭০ জনের ওরিয়েন্টেশন হয়েছে।

তিনি জানান, ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত রুটে প্রাথমিকভাবে ১০০টি একতলা বাস চলাচল করবে। রোববার ৫০টি গাড়ি নামবে। বাকি বাসগুলো আসতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। শুরুতে কয়েকটি পুরোনো বাস থাকলেও পর্যায়ক্রমে সব নতুন বাস আসবে।

রোববার যেসব বাস থাকবে, সেগুলোর মধ্যে ২০টি বাস বেসরকারি কোম্পানির ট্রান্স সিলভা বিডির এবং ৩০টি বিআরটিসির দ্বিতল বাস। এসব বাস চলবে ঢাকা নগর পরিবহনের ব্যানারে।

ট্রান্স সিলভা বিডির বাসগুলো পুরোনো। আইসার ও টাটা ব্রান্ডের তৈরি এসব বাস ২০২০ মডেলের। বাস ফ্রাঞ্চাইজিতে যুক্ত করার আগে বাসগুলো আবার মেরামত করা হচ্ছে।

শুক্রবার মাতুয়াইলে ট্রান্স সিলভার মেরামত কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে বাসগুলো। রঙ করা, গ্লাস লাগানো, সিটের কাভার পাল্টানোর কাজ করা হচ্ছে।

কয়েকটি মেরামতের পর রঙ করে পুরোপুরি তৈরি করা হয়েছে। এসব বাসের লেখা হয়েছে ‘ঢাকা নগর পরিবহন।’

ট্রান্স সিলভা বিডির চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম খোকন বলেন, “কাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রক্রিয়ায় কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। আমরা এই পাইলটিং থেকে শিক্ষা নিয়ে ঢাকায় এই সেবা ছড়িয়ে দেব। “গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে, যাত্রীসেবা বাড়বে। সবাই সুন্দর উদ্যোগ নিলে অসফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি এই পরিবহন সেবার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী।”

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসগুলো রাখা আছে মোহাম্মদপুর ডিপোতে। ভারতের অশোক লিল্যান্ডের দ্বিতল বাসগুলো ২০১৯ সালের তৈরি। বিআরটিসির লাল রঙয়ের এসব বাসে থাকছে ঢাকা নগর পরিবহনের সবুজ স্টিকার।

রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থার চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রাথমিকভাবে বিআরটিসি ৩০টি বাস দিচ্ছে। বাস রুট রেশনালাইনজেশন কমিটি যদি আরও বাস চায় তাও সরবরাহ করা যাবে।

“আমরা শতভাগ আশাবাদী। আমাদের তো বিভিন্ন রুটে বাস চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। এ কারণে সমস্যা হবে না। আমাদের কাছে প্রচুর গাড়ি আছে। চাহিদা অনুযায়ী যদি আরও গাড়ি প্রয়োজন হয় তাহলে দেওয়া যাবে।”

ডিটিসিএর ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম জানান, প্রাথমিকভাবে এসব বাস নেওয়া হয়েছে। নতুন বাস তৈরি করছে কয়েকটি কোম্পানি, তাদের দুই মাসের সময় দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এসব বাস রাস্তায় চলে আসবে। তখন বিআরটিসির দ্বিতল বাসগুলো থেকে ২০টি বাস কমিয়ে ফেলা হবে।

“বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ৯০টি বাসের মধ্যে ৭০টি একেবারেই নতুন হবে।”

ডিটিসিএর এই কর্মকর্তা জানান, বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশন কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা মহানগরীতে প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য বেসরকারি পরিবহনগুলো মিলে যৌথ কোম্পানি গঠন করবে। তারা একটা ব্যানারে বাস চালাবে। এজন্য একটা নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।

“একেকটা ক্লাস্টারে অনেকগুলো রুট। আমরা ঘাটারচর দিয়ে শুরু করছি। আস্তে আস্তে সবগুলো রুটই চালু হয়ে যাবে।”