সার্জেন্টের বাবাকে গাড়িচাপা: দুদিন আগে চালকের জিডি নিলেও মামলায় তার নাম নেই

ঢাকায় গাড়ির ধাক্কায় অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য মনোরঞ্জন হাজং আহত হওয়ার ঘটনায় তার মেয়ে পুলিশ সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের মামলা নিতে বনানী থানা দেরি করলেও তার দুদিন আগে গাড়ির চালক সাঈদ হাসানের জিডি নিয়েছিল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2021, 04:42 AM
Updated : 19 Dec 2021, 05:09 AM

দুর্ঘটনার ১৩ দিন পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত ১৬ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন আইনের ৯৮ ও ১০৫ ধারায় মহুয়ার করা মামলা রেকর্ড করে বনানী থানা। সেখানে গাড়ির চালকের নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতনামা দুজনকে আসামি দেখানো হয়।

কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, ওই মামলা নেওয়ার আগেই ১৪ ডিসেম্বর গাড়ির চালক সাঈদ হাসান বনানী থানায় জিডি করেন। সেখানে দুর্ঘটনার জন্য ‘উল্টো পথে থাকা’ মোটরসাইকেলআরোহী মনোরঞ্জন হাজংকেই দায়ী করেন তিনি। অথচ দুদিন পর মহুয়ার দায়ের করা মামলায় আসামিদের দেখানো হয় ‘অজ্ঞাতপরিচয়’।

মহুয়ার দাবি, তিনি গাড়ি চালক সাঈদ হাসানের নাম উল্লেখ করেই মামলা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সেটা নেওয়া হয়নি।

সাঈদের জিডির পরেও কেন মহুয়ার মামলায় আসামিদের নাম উল্লেখ করা হয়নি প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর দেননি বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া।

জিডির বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ওই জিডির তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়ার পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।

মহুয়া হাজংয়ের করা মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, “আমরা সেই মামলাটিও তদন্ত করছি।”

ওই বিএমডব্লিউ গাড়ির চালক সাঈদ হাসানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

গত ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হন অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য মনোরঞ্জন হাজং। দুই দফা অস্ত্রপচারে তার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। তিনি বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

মনোরঞ্জনের একমাত্র মেয়ে মহুয়া হাজং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সার্জেন্ট। গত ১৫ ডিসেম্বর মহুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বাবাকে ধাক্কা দেওয়া লাল রঙের বিএমডব্লিউ গাড়িটির চালকের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে বনানী থানা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

অবসরে থাকা মনোরঞ্জন গুলশানের এক রেস্তোঁরায় নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। ওই দুর্ঘটনার খবর বিভিন্ন টেলিভিশন স্টেশনে প্রচার করা হয়।

গত ১৪ ডিসেম্বর যমুনা টিভিতে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখানো হয়, দুর্ঘটনার পর একটি লাল রঙের বিএমডব্লিউ গাড়ি জনতা আটক করে পুলিশে দেয়। গাড়ির চালকের ছবিও দেখানো হয়।

মামলা না নেওয়ার বিষয়ে ওই টেলিভিশনকে টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, “বিষয়টা আমাদের সদস্যের। আমাদের একটা সিনিয়র কমান্ড আছে, অথরিটি আছে, সবই আছে। আমার তো মনে হয় যে এটা আপনাদের (গণমাধ্যমে) পর্যায়ে যাওয়ার কোনো দরকার ছিল না।

“আমাদের সহকর্মী মামলা না করতে পারার তো কোনো কারণ নেই। এটা তদন্ত হচ্ছে, তদন্তের পরেই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।“

সাঈদের জিডিতে যা আছে

দুই পৃষ্ঠার জিডিতে সাঈদ হাসান লিখেছেন, ২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার (ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৩ ডিসেম্বর) রাত ২টার দিকে তিনি গাড়ি চালিয়ে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ হয়ে কাকলী চৌরাস্তা দিয়ে বিমানবন্দর সড়কে ওঠেন। এরপর বাঁয়ে মোড় নিয়ে চেয়ারম্যানবাড়ি ইউলুপের মুখে এসে তার গাড়ি উল্টোপথে আসা একটি মোটরসাইকেলের সামনে পড়ে। মোটরসাইকেলটির সামনের অংশ গাড়ির বাঁ পাশে ধাক্কা খায়। তাতে গাড়িটি ইউলুপের দেওয়ালে লেগে যায়।

তিনি লিখেছেন, “আমার গাড়িটি মোটরসাইকেলকে চাপা দেয় নাই বা পিছন থেকে ধাক্কা দেয় নাই। বরং বেআইনিভাবে উল্টো দিক থেকে এই ইউলুপে প্রবেশ করে অগ্রসরমান ঐ মোটরসাইকেলআরোহী আমার গাড়ির বাম পাশের হেডলাইটে লাগিয়ে দেয় এবং এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।”

দুর্ঘটনাস্থলে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের অবস্থান চিহ্নিত করে কিছু ছবিও জিডির সঙ্গে জমা দিয়েছেন সাঈদ হাসান। পুরো ঘটনা সড়কের সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে এবং স্থিরচিত্রও আছে বলে সেখানে তিনি জানিয়েছেন।

সাঈদ লিখেছেন, “আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও আমার স্ত্রীর ডানহাতের তিনটি আঙ্গুল ফ্র্যাকচার হয়। আমি ঘাড়ে ব্যথা পাই। আমি রাতেই ইউনাইটেড হাসপাতালে জরুরি বিভাগে যাই। আমার স্ত্রীকে ৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। তার ডানহাতের তিনটি আঙ্গুলে ফ্র্যাকচার হয়। তার হাতের প্লাস্টার এখনও খোলা হয়নি।”

জিডিতে বলা হয়েছে, ওই মোটরসাইকেল চালকের নাম মনোরঞ্জন হাজং বলে পরে জানতে জানতে পারেন সাঈদ। মনোরঞ্জনের চিকিৎসার জন্য ৩ ডিসেম্বর দুই দফায় ‘পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা’ দেওয়া হয়। তাকে পরে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হলে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে একাধিকবার আলাপ করেন সাঈদ এবং তার পরিবারের লোকজন।

“পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক নিজে শুক্রবার জুমার পর মনোরঞ্জন হাজংকে দেখতে যান। তারা শুক্রবারেই অপারেশনের ব্যবস্থা নেন। পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে অপারেশনের পর ওই রোগীর জন্য বেডের ব্যবস্থা করা হয় (চরম বেড সংকটের মধ্যেও)। পরবর্তীতে কেবিন বরাদ্দ করা এবং মেডিকেল বোর্ড গঠন করার ব্যবস্থা করে চিকিৎসার যাবতীয় বন্দোবস্ত করা হয় আমার পক্ষ থেকে।”

সিসি ক্যামেরার ভিডিওর বিবরণ দিয়ে সাঈদ তার জিডিতে বলেছেন, মনোরঞ্জন হাজং ‘সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এবং ট্রাফিক নিষেধ অমান্য করে উল্টো পথে’ ইউলুপে প্রবেশ করেন এবং অন্য দিকের রাস্তায় ওঠার জন্য এগিয়ে যান।

“মনোরঞ্জন হাজং জানেন যে, উল্টো দিক থেকে এই ইউলুপে প্রবেশ করে ইউটার্ন নেওয়া বা ডিভাইডারের পূর্বের রাস্তায় ওঠার চেষ্টা বা ইউলুপে পার্কিং করা ট্রাফিক আইনে নিষিদ্ধ, অনিরাপদ এবং তার এইরূপ কাজের জন্য রাস্তার পূর্বপাশে চলাচল করা যে কোনো গাড়ি এবং এর চালক ও আরোহী মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার এবং প্রাণনাশের ঝুঁকির সম্মুখীন হবে, যেভাবে আমরা হয়েছি।”

ওই ঘটনায় নিজের কোনো দায় ছিল না দাবি করে সাঈদ লিখেছেন, “যেহেতু ওই ঘটনাস্থলের আলোকে মামলা হলে এই ঘটনার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব মনোরঞ্জন হাজংয়ের ওপর বর্তায় এবং তাকে আসামি করেই মামলা করতে হয়, সে কারণে আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় নাই, আমার গাড়িও আটক রাখা হয় নাই। গাড়িটি বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কারণে আমরা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। আমি ও আমার স্ত্রী এই ঘটনার ভিকটিম। কেবলমাত্র প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কারণে এর দায় আমার নয়।”

জিডির শেষে সাঈদ হাসান লিখেছেন, ‘অহেতুক হয়রানি অপপ্রচার, মিথ্যা মামলা, মানসিক নির্যাতন, অর্থের জন্য চাপ দেওয়া- ইত্যাদি নানা আশঙ্কা থেকে এবং প্রকৃত বিষয় উদ্ঘাটনের জন্য’ তিনি জিডিটি করছেন।