কেমন ছিল লাখো শহীদের রক্তে রাঙানো মহাবিজয়ের সেই দিন

নয় মাসের প্রাণপণ লড়াই আর আত্মত্যাগের ফল এল মহাকাব্যিক বিজয়ে; পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দিকে দিকে পৌঁছে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়োল্লাস।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2021, 06:47 PM
Updated : 16 Dec 2021, 09:16 AM

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর- কেমন ছিল সেই দিন?

পঞ্চাশ পেরোনো বাংলাদেশে ইতিহাসের সেই অগ্নিসাক্ষীদের সংখ্যা কমে আসছে ক্রমেই। আজও যারা নতুন প্রজন্মের মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছেন, তাদের স্মৃতিতে বাঙালির সেই বিজয়লগ্ন জীবনের আর সব কিছুর চেয়ে দামী।  

“এই আবেগটা বলে বোঝানো মুশকিল। ঢাকা শহর কিন্তু প্রায় বিরান শহর ছিল। কিন্তু যে যেখানে ছিল রাস্তায় বেরিয়ে আসছে, বিজয় উল্লাসের সঙ্গে বেদনাটাও ছিল,” বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, গবেষক-প্রকাশক মফিদুল হক।

বাঙালির ইতিহাসে অনন্য সেই দিনটিতে তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মেলে ধরেছেন অর্ধশতক আগের সেই স্মৃতির ঝাঁপি।

মফিদুল হক বলেন, “বহু মানুষ বহুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিবার ছিল না, যারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের যে মাহেন্দ্রক্ষণ, তা অশ্রু, বেদনা এবং আনন্দে ভরপুর একটা সময় ছিল।”

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন যুদ্ধে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

এরপর নয় মাস চলে তীব্র লড়াই। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন এগিয়ে চলে পূর্ণতার পথে।

মফিদুল হক বললেন, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তিনি ভেতরে ভেতরে অনুভব করতে শুরু করেছিলেন- বিজয় ওই আসছে! সেই অপেক্ষা ফুরালো ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন সকালে ভগ্নিপতি সৈয়দ শরফুল আনামের গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লেন ঢাকার পরিস্থিতি দেখতে।

“বেলা ১১টা-১২টার দিকে বোঝা গেল, যুদ্ধ শেষ হতে যাচ্ছে। ভারতীয় একটি বাহিনী প্রবেশ করল, এখন যেটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সেটার সামনে এল।

”আমরা ১১টা, সোয়া ১১টার দিকে হোটেলের সামনে ছিলাম। দেখলাম উল্লসিত মানুষ তাদের বরণ করে নিল, পাকিস্তানি বাহিনী তখন ফিরে যাচ্ছিল, কিন্তু সশস্ত্র অবস্থায় ছিল তারা। ফলে গোলাগুলি হল, ভারতীয় একজন অফিসারও সেখানে মারা গেলেন, খুব করুণ ঘটনা।”

মফিদুল হক

সেখান থেকে ডেমরার দিকে যাওয়ার আগে তৎকালীন গভর্নর হাউজের (বর্তমান বঙ্গভবন) ভেতরেও ঢুঁ মারেন মফিদুল হকরা, যেখানে তার দুদিন আগে আক্রমণ করেছিল ভারতীয় বিমান বাহিনী।

মফিদুল হক বলেন, সেদিন তারা ডেমরার পরিস্থিতি দেখে ঘুরে আসার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়ে যায়।

“সবাই তখন ফিরছিল, আমরা বিমানবন্দরে গেলাম। সেখানে জেনারেল অরোরাকে নিয়ে হেলিকপ্টারটা তখনই উঠেছে। মেজর হায়দার ছিলেন তখন বিমানবন্দরে, সেখানে তার সঙ্গে দেখা হল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলেই যে এই বিজয়, সেটা কিন্তু আমরা সবসময় প্রত্যক্ষ করে গেছি। ঢাকা বিমানবন্দরের সেই সন্ধ্যার দৃশ্যটা খুব মনে পড়ে।”

একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বিজয়ের বন্দর আর বেশি দূরে নয়। এর পর থেকে একে একে মুক্ত হতে থাকল দেশের বিভিন্ন এলাকা। পর্যুদস্ত হতে থাকল পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসররা।

৮ ডিসেম্বর ডেইলি মিরর শিরোনাম করেছিল আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো প্রসঙ্গে

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল

ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ৮ ডিসেম্বর প্রথমবারের মত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালেন পাকিস্তানি সৈন্যদের।

সর্বাত্মক যুদ্ধ চলার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াও। জেনারেল মানেকশ মাইক্রোওয়েভে তৃতীয় তারবার্তা পাঠালেন পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছে।

বললেন, মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে ফেলেছে। আত্মসমর্পণ করা বাঞ্ছনীয় হবে। বৃথা আর রক্তপাত করে লাভ নেই। আত্মসমর্পণ করলে সৈন্যদের সাথে জেনেভা কনভেনশন মেনে আচরণ করা হবে।

রেডিও বার্তার পাশাপাশি বিমান থেকেও লিফলেট ফেলে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় তখন।

হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ওই লিফলেটে পাকিস্তানি বাহিনীকে বলা হচ্ছিল, ‘হাতিয়ার ডাল দো’ বা আত্মসমর্পণ করো। না হলে সামনে সমূহ বিপদ।

যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মিত্র বাহিনী ঢাকার তিন দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর একটি দল আসে সাভারের দিক থেকে, একটি ডেমরার দিক থেকে এবং অন্য একটি টঙ্গীর দিক দিয়ে।

তবে ঢাকার উপকণ্ঠে সবার আগে পৌঁছে যান জেনারেল জি এস নাগরার অধীনস্ত সন্ত সিংয়ের দল। তারা ১৪ তারিখ রাত ১০টার দিকে এগিয়ে যান সাভার-মিরপুরের দিকে। কয়েক ঘণ্টা পর, ১৫ ডিসেম্বর ভোররাতে তারা ধামরাইয়ের পশ্চিম দিকের ফেরিঘাট দখল করে নেন।

বেতার সম্প্রচার ভবনের কাছে পাকিস্তানিরা তাদের বাধা দিতে চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটে যায়। সন্ত সিংয়ের এই দলই সবার আগে পৌঁছে যায় মিরপুর ব্রিজের কাছে। তাদের সঙ্গে ছিল কাদের বাহিনী।

জন্ম নিল স্বাধীন দেশ, বদলে গেল পত্রিকার মাস্টহেড। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ’দৈনিক পাকিস্তান’ কেটে হল ‘দৈনিক বাংলাদেশ’।

পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এটিএম হায়দার এবং ভারতীয় সেনাপতিরা।

আত্মসমর্পণের আলোচনা চলার মধ্যে মানেকশ তাই ১৫ তারিখ বিকেল পাঁচটা থেকে ১৬ তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত বিমান হামলা না করার নির্দেশ দেন।

এর মধ্যে আত্মসমর্পণের দলিল ও শর্তাবলি চূড়ান্ত করার কাজ চলে, যার অগ্রভাগে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব।

নিজের লেখা ‘সারেন্ডোর অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব আ নেশন’ বইয়ে সেই সময়ের ঘটনার বর্ণনা করেছেন তিনি।

জ্যাকব লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় জেনারেল মানেকশ ফোন করে তাকে অবিলম্বে ঢাকায় যেতে বলেন। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে বলেন।

এরপর ক্যান্টনমেন্টে দুপুরের খাবারের সময় চলে নিয়াজি আর জ্যাকবের আত্মসমর্পণের দলিল ও শর্ত ঠিক করার আলোচনা। পরে তারা ঢাকা বিমানবন্দরে যান ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে স্বাগত জানাতে। তিনি ছিলেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান। বিমানবন্দর থেকে তারা যান রমনার রেসকোর্স ময়দানে।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে অস্ত্র জমা দিচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা

জ্যাকব লিখেছেন, আয়োজনের জন্য সময় খুব কম পেলেও মোটামুটি ভালোভাবেই সব শেষ হয়। গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলির টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজি সেটার ওপরে কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে নিয়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন।

পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টাইমস ঢাকার পরিস্থিতির বর্ণনায় লিখেছিল, “ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিল দস্তখতের জন্য একটি টেবিল বসানো হয়েছে। তখন ডিসেম্বরের শীতের পড়ন্ত রোদ। দূর থেকে অবিরাম গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। আর জনতা মুহুর্মুহু চিৎকার করছে।

”একটু পরেই গম্ভীর ও কালো মুখে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করলেন। ভারতীয় সৈন্যরা প্রায় পুরো ময়দানটাই কর্ডন করে বাঙালি জনতাকে অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছে। জেনারেল নিয়াজিকে যখন ফেরত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তার চোখে পানি আর বাঙালি জনতা চারদিক থেকে চিৎকার করছে।”

হারুন হাবীব

মুক্তিযোদ্ধা, রণাঙ্গনের সাংবাদিক হারুন হাবীবের বর্ণনায় পাওয়া যায় সেদিন ময়মনসিংহে জনতার বিজয়োল্লাসের চিত্র।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি ময়মনসিংহ শহরে আহত হয়ে আছি। রেডিওতে শুনছি ময়মনসিংহ হাসপাতালে শুয়ে, যেটা এখন মেডিকেল কলেজ।

”ওইখানে আমি দেখলাম, শত শত লোক আসছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নার্স, ডাক্তার সব। রেডিওতে ধারা বিবরণী হচ্ছে আত্মসমর্পণের। আমার মনে হল বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে যাই, কিন্তু ডাক্তার আর নার্স আমাকে যেতে দিচ্ছে না। তারা জানে যে, আমার আরও বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।”

হারুন হাবীব বলেন, পুরো ময়মনসিংহ শহরে সেদিন হাজার হাজার লোক, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ইন্দিরা গান্ধী, জয় ভারত- স্লোগান দিচ্ছিল।

“আর আমি হাসপাতালের তিন তলায় শুয়ে শুয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম, ‍শুনছিলাম।”